Trending
নিজেকে সুন্দর দেখানোর নেশায় বুঁদ হয়ে কখনও গালে লাগাচ্ছেন হাইলাইটার তো কখনও চোখে মাখছেন আই শ্যাডো। কিন্তু কাদের পরিশ্রমের বিনিময়ে আপনি এতটা সুন্দর হয়ে উঠছেন, সেই প্রশ্ন নিজেকে কোনোদিন করেছেন? যে মেকআপ প্রোডাক্ট আপনি ব্যবহার করেন, তার উপাদানের একটা লম্বা লিস্ট তো গুগল করলেই পেয়ে যাবেন। কিন্তু যে উপাদানটির উল্লেখ কোথাও নেই, সেটা কী জানেন? জীবন। হাজার হাজার শিশু শ্রমিকের কোমল, সুন্দর জীবন। প্রাইমার,ফাউন্ডেশন, আইশ্যাড দিয়ে নিজেকে সুন্দর দেখানোর অজুহাতে যাদের জীবনের কথা ভাবার আপনার অবকাশ নেই। আপনার এই উজ্জ্বল লুকের পিছনে যে কতটা অন্ধকার লুকিয়ে রয়েছে, সেই সত্যিটা জানলে আপনিও হয়তো মেকআপ ব্যবহারের বিষয়টা পুনর্বিবেচনা করবেন। আজ আমরা জানব, উজ্জ্বল বিউটি ইন্ডাস্ট্রির পেছনে লুকিয়ে থাকা রক্তাক্ত সত্যটা।
মাইকা। বাংলায় যাকে আমরা অভ্র বলে জানি। স্বচ্ছ, উজ্জ্বল। মেকআপ ইন্ডাস্ট্রিতে যার একচ্ছত্র রাজ। যেহেতু এর নিজস্ব কোন রং নেই, তাই ঔজ্জ্বল্য বাড়ানোর জন্য যেকোনো মেকআপের মধ্যে মাইকা ব্যবহার করা যায়। যে মেকআপ ছাড়া আপনি রাস্তায় বেরনোর কনফিডেন্স পান না। যে মেকআপ আপনাকে বাইরে থেকে সুন্দর তো করে তোলে, কিন্তু মনের অন্ধকারকে দূরে সরাতে পারে না। যে মেকআপ ব্যবহার করার আগে হাজার হাজার শিশু শ্রমিকের নিত্যদিনের অভাব, শ্রম আর রক্ত আপনাকে ভাবায় না। সেই মেকআপ তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল হচ্ছে এই অভ্র। অভ্রের সোর্সটা কোথায় জানেন? এই ভারতেই। বিহার আর ঝাড়খণ্ড হচ্ছে এই অভ্রের আঁতুড়ঘর। আর এই অভ্র সংগ্রহের পিছনেই লুকিয়ে রয়েছে বিউটি ইন্ডাস্ট্রির ভয়াবহ সত্যি। যে সত্যিটা অস্বীকার করতে যায় কোটি কোটি টাকার এই ইন্ডাস্ট্রি।
ঝাড়খণ্ড। ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য। যেখানকার মাটির নীচে লুকিয়ে রয়েছে মেকআপ খাজানা। আর যার সীমান্তে চীনের প্রাচীরের মতো পাহারা দিচ্ছে মাইকা মাফিয়ারা। এই খনি এলাকায় গেলে আপনি বুঝতে পারবেন, এ এক অন্য পৃথিবী। এখানে কাজ করে ছোট ছোট শিশুরা, যাদের বয়স ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। বলা ভালো, কাজ করানো হয়। যারা খেলনাবাটি খেলার বয়সে, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায়। মেকআপ তৈরির অভ্রের জোগান দিতে গিয়ে যারা কয়েক সেকন্ডের ব্যবধানে লাশ হয়ে যাচ্ছে। খনির ঘুটঘুটে অন্ধকার গর্তে ঢুকতে যাদের ভয় পেতে নেই। কালো কাজল, রঙিন লিপস্টিক আর উজ্জ্বল হাইলাইটারের আড়ালে আপনি যখন কারও স্বপ্নের মানুষটি হয়ে ওঠার জন্য নিজেকে সাজাচ্ছেন, তখন সে হয়তো ভাবছে, আজ তার পালা কি না! মাটি চাপা পড়ার। রঙিন দুনিয়ায় আপনার ধারনার ত্রিসীমানায় এই ভাবনা আসবে না, সেটাই স্বাভাবিক। যদিও মাইকা খনি এলাকায় এসব ঘটনা আকচার হয়। তবু জীবনকে একটু সহজ করার প্রত্যাশায় তারা প্রতিদিন খনি এলাকায় যেতে বাধ্য হয়। ৮-৯ ঘণ্টা হাড়ভাঙা খাটুনির পর তাদের পারিশ্রমিক কত জানেন? ২০ বা ৩০ টাকা। আর আপনার কারেন্ট ফেভারিট ব্র্যান্ডের হাইলাইটারটার যেন কত দাম?
এই পুরো কাজটাই হয় সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে। অথচ কি অদ্ভুত ভাবুন, সবটা জেনেও রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার একেবারে চুপ। অবশ্য অন্য কোন উপায়ও তো নেই। ২০১৯ সাল নাগাদ সরকারি দল থেকে সার্ভে করা হয় যে, খনি এলাকায় কতজন শিশুশ্রমিক কাজ করে। তবে ঐ সার্ভেই সার, রিপোর্ট আজও অপ্রকাশিত। আর ঠিক এভাবেই প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে শিশু শ্রমের এক নগ্ন অধ্যায় রচিত হয় এই নিষিদ্ধ এলাকায়। এখন আপনার মধ্যে জেগে ওঠা প্রতিবাদী স্বত্বা প্রশ্ন তুলতেই পারে, যে এত কম টাকার জন্যে এরা কাজ করে কেন? শিশু শ্রম তো অপরাধ, এরা স্কুলে যায় না কেন? চোখে আইশ্যাডো আর গালে হাইলাইটার লাগাতে লাগাতে এই প্রশ্ন করাই যায়। কিন্তু যাদের দিনের পর দিন পেট ভরাতে পারে না, তাদের কাছে এই প্রশ্ন রাখা অপ্রাসঙ্গিক। তাই দিনশেষে তাদের প্রাণের মায়া করাটাও কাছে বিলাসিতা। আর দমবন্ধ করা জীবনে অন্ধকার খনিতে দিনের পর দিন কাজ করতে গিয়ে কত মায়ের কোল খালি হয়ে যাচ্ছে, সেই খোঁজ রেখেছেন কোনদিন? শুধু ঝাড়খণ্ডেই নাকি প্রতিদিন গড়ে একজন শিশু মারা যায় বলে জানা যাচ্ছে। তাহলে বছরে…!!! এই হিসেব কি সরকারের কাছে রয়েছে?
খনির অভ্র কিনে নেয় খনি ব্যবসায়ীরা। তারপর জাহাজে চড়ে সেগুলো চলে যায় চিনে। সেখান থেকে আরও বেশি করে প্রসেস করা হয়। আর সবশেষে ব্যবহার করা হয়, মেকআপ, টুথপেস্ট, অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদি ক্ষেত্রে। তবে এই অন্ধকার সত্যিটা জানার পর লোটাস সহ আরও অনেক মেকআপ ব্র্যান্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এইভাবে বেআইনিভাবে তোলা অভ্র বিউটি ইন্ডাস্ট্রিতে তারা আর ব্যবহার করবে না। তাহলে কি অভ্র বয়কট করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে? তাহলে এখানকার শিশুশ্রমিকদের ভবিষ্যৎ কী হবে? বরং সবদিক বিবেচনা করে সরকার যদি এখানে একটা সুষ্ঠ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে পারে, তবে এখানকার মানুষগুলো বাঁচার রসদ খুঁজে পায়। অন্ধকার জীবন থেকে বেরিয়ে শিক্ষার আলো গায়ে মাখতে পারে শিশুরা। আর বাবা মায়েদের হতে পারে দারুন একটি কর্মসংস্থানের সুযোগ। তবে যেভাবে কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রিতে মাইকার ডিম্যান্ড বাড়ছে, তাতে এমন ভাবনা বাস্তবায়িত করা কঠিন হলেও সম্ভব। “The business of beauty is very ugly”-বিউটি ও ফ্যাশন এক্সপার্ট ক্যারি হ্যামারের এই কথাটা যে কতটা সত্যি সেটা আশা করি বুঝতে পারলেন।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ।