Trending
আচ্ছা যদি আপনাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে শিশুদের মৃত্যু হয় অপুষ্টি এবং অনাহারে। নেই সু-চিকিৎসার ব্যবস্থা। আর স্কুলশিক্ষার কথা না-হয় বাদই দিলাম। এখানে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি অধিকাংশ জায়গায়। দারিদ্র্যের ছাপ প্রত্যেকটা ঘরে। সত্যি বলতে কি, আজ যেখানে আধুনিকতা এবং উন্নয়নের জোয়ারে গা ভাসিয়ে প্রত্যেকটা দেশ অসম প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে, সেখানে এমন একটি জায়গার কথা কি আপনার কল্পনাতেও আসতে পারে? তবে বলে রাখি, আমাদের নীল গ্রহে এমন একটি দেশ রয়েছে যেখানে উন্নয়নের কোন রঙিন বার্তা পর্যন্ত আসে না। এখানে খিদের চোটে মানুষের মৃত্যু স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে প্রতি ১ লক্ষ মানুষের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৫ জন ডাক্তার। বিশ্বের সুখী দেশের তালিকায় এই দেশের ঠাঁই একেবারে নিচে। দেশটির নাম বুরুন্ডি। পৃথিবীর অন্যতম গরীব একটি দেশ। আজকের প্রতিবেদনে কথা বলব, আফ্রিকায় অবস্থিত পৃথিবীর গরীবতম দেশ বুরুন্ডি নিয়ে।
পূর্ব আফ্রিকায় অবস্থিত ল্যান্ড লকড দেশ হল এই বুরুন্ডি। বুরুন্ডিকে ঘিরে রয়েছে কঙ্গো, তানজানিয়া এবং রুয়ান্ডা। এই দেশটির অধিকাংশ এলাকা ভূমিবেষ্টিত হবার কারণে জলের পরিমাণ খুবই কম। দেশটিতে ব্যবহারযোগ্য জলের পরিমাণ ৭ শতাংশের সামান্য বেশি। বুরুন্ডির পশ্চিমপ্রান্তের কিছুটা জায়গায় অবস্থান করছে পৃথিবীর দ্বিতীয় গভীরতম হ্রদ- টাঙ্গানিকা। সত্যি বলতে কি, এই দেশটির আয়তন বেশ কম। মাত্র ২৭ হাজার ৮৩৪ বর্গ কিমি। কিন্তু এতো ছোট একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও, বুরুন্ডিতে জনঘনত্ব আফ্রিকার অন্যান্য দেশের থেকে অনেকটাই বেশি। এই দেশে প্রতি বর্গকিমি-এ বসবাস করেন ৩১৫ জন মানুষ। আফ্রিকা মহাদেশে বুরুন্ডি হচ্ছে দ্বিতীয় ঘন জনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। প্রথম স্থানে রয়েছে রুয়ান্ডা- সেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বসবাস করেন প্রায় ৪০০ জন মানুষ। বুরুন্ডির রাজধানীর নাম হল বুজুম্বুরা। এই দেশে মূলত দুটি ভাষা ব্যবহার করা হয়। একটি রুন্ডি এবং অন্যটি ফরাসি। এই দেশের প্রধান ধর্ম হচ্ছে খ্রিস্টান। রোমান ক্যাথলিকদের সংখ্যা এখানে কম নয়। তবে মুসলিমদের সংখ্যা এই দেশে বেশ কম। জানা যায়, মুসলিম ব্যবসায়ীদের হাত ধরে এই দেশে ইসলাম ধর্ম ঢুকে পড়ে। তবে এটি এমনই একটি দেশ, যে দেশে ব্রিটিশদের অত্যাচার এসে পড়েনি। ১৮৯০ সাল নাগাদ দেশটি নিজেদের হাতে নিয়েছিল জার্মানি। কারণ ১৮৮০ সাল থেকেই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশকে নিজেদের মধ্যে অধিগ্রহণ করবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল ইউরোপের রাষ্ট্রশক্তিগুলো। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের পরাজিত করে বেলজীয় সৈনিকরা। তারপর বুরুন্ডি চলে যায় তাদের দখলে। ১৯১৯ সাল থেকে বেলজিয়াম সরকারের শাসনে ছিল বুরুন্ডি। যদিও ১৯৬২ সাল নাগাদ বুরুন্ডি পরাধীনতার হাত থেকে নিষ্কৃতি পায়। এবং রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বুরুন্ডিকে কোনভাবেই রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল একটি দেশ বলা যাবে না। তবুও ১৯৬৬ সালে বুরুন্ডি একটি প্রজাতন্ত্র দেশ হিসেবে গ্লোবাল ম্যাপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে বুরুন্ডিতে যেকটি সবচেয়ে প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ৩টি- হুতু, তুৎসি এবং তোওয়া।
বুরুন্ডির অধিকাংশ মানুষই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। প্রায় ৮০% মানুষ চাষবাস করেন এখানে। এরা মূলত হুতু সম্প্রদায়ের লোক। এই দেশের প্রধান চাষবাস হল কফি এবং চা। এছাড়া বুরুন্ডি-তে চাষবাস করা হয় তুলো, ভুট্টা এবং মিষ্টি আলু। বুরুন্ডির জমি কৃষিকাজের জন্য উপযোগী হলেও এখানে খাদ্যাভাব সর্বত্র। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির যে তালিকা প্রকাশ পেয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে বুরুন্ডির মোট শিশু যাদের বয়স ৫ বছরের কম, তাদের ৫৬.৮% অপুষ্টির শিকার। খাদ্যাভাবে শিশুদের মৃত্যু ঘটে বুরুন্ডির ঘরে ঘরে। জিডিপির হার এখানে একেবারে সর্বনিম্ন। দারিদ্র্যের চাবুক সহ্য করলেও বুরুন্ডির পরিবারগুলো বেশি সংখ্যায় সন্তান নেয়। ফলে অভাব আরও চওড়া হয় দিনদিন। শিশুদের জন্য এই দেশে পাওয়া যায় না কোনরকম খেলার সামগ্রী। যাও বা হাতে গোনা স্কুল রয়েছে, সেই স্কুলের দূরত্ব এতটাই যে, শিশুদের কয়েক ঘন্টা হেঁটে হেঁটে স্কুলে পৌঁছতে হয়। সুতরাং, অধিকাংশ শিশুই যে অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। গোটা দেশে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে রয়েছে মাত্র একটি। তবে জানা গিয়েছে, ২০১৮ সালে বুরুন্ডি সরকার শিক্ষাখাতে জিডিপি’র ৫.১% অর্থ ঢেলেছে। তারপরেও যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ছবিটা বদলেছে, এমন কথা বলা যাবে না। এখানে প্রত্যেকটি মানুষ অকথ্য পরিশ্রম করেন। কিন্তু পরিশ্রমের জন্য মাসের শেষে পর্যাপ্ত পারিশ্রমিকটুকু পান না। এদের রোজগার সাকুল্যে মাসে ৮ থেকে ১০ ডলার মতন। তাই দিয়েই কোনরকমে ৮-১০ জনের সংসার চলে টেনেটুনে। যে দেশে গরিবিয়ানা এতো মারাত্মক আকার নিয়েছে, সেই দেশের কোণে কোণে বিদ্যুৎ পৌঁছনো যে বিলাসিতার একটা অংশ মাত্র, সেটা কি বলে দিতে হবে? দেশের মাত্র সাড়ে সাত শতাংশের কিছু বেশি মানুষের বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছয়। বাকি এলাকা অন্ধকারে ডুবে থাকে সারাক্ষণ। কাজের সূত্রে যাতায়াতের জন্য গাড়ি বা পাবলিক ভেহিকল ব্যবহার করার মতনও সামর্থ্য এদের নেই। তাই অধিকাংশ মানুষ সাইকেলের ওপরেই ভরসা রাখেন। সাইকেলে চেপে চলন্ত ট্রাকের একটি কোন ধরে তারা যাতায়াত করে, যেটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বুরুন্ডির পরিবহন ব্যবস্থা একেবারেই উন্নত নয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই দেশে সেভাবে কোন পাকা রাস্তাই ছিল না। দেশের ১০% রাস্তা ছিল পাকা। ছিল না বাস, লড়ি যাতায়াত করার মত শক্তপোক্ত সড়ক। বুরুন্ডিতে একটাই মাত্র বিমানবন্দর রয়েছে। সেটা বুরুন্ডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এমনকি এই দেশে ইন্টারনেট পরিষেবার হালও তথৈবচ।
বুরুন্ডির অর্থনীতিতে মহিলাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোট কর্মক্ষমতার ৫৫.২% রয়েছে নারীদের হাতে। ফলে এই দেশের মহিলাদের পরিশ্রমটা অন্যান্য দেশের থেকে অনেকটাই বেশি। যেহেতু এই দেশের মানুষ অধিক সন্তান জন্ম দেওয়াকে কল্যাণকর বলে মনে করে, তাই মহিলাদের সন্তান সঙ্গে নিয়েই দূর দূর পর্যন্ত কাজে যেতে হয়। এছাড়া জল আনা, কাঠ সংগ্রহ করার জন্য মহিলাদের যেতে হয় অনেকটা পথ। কিন্তু এতো কিছুর পরেও বুরুন্ডির পুরুষ সমাজ নারীদের উপর অবহেলা এবং অত্যাচারকেই মুখ্য করে তোলে। যে কারণে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্সে বুরুন্ডি রয়েছে সবচেয়ে নিচের দিকে। তবে এতো কিছু সত্ত্বেও বুরুন্ডির সংস্কৃতি অত্যন্ত গভীর। বিভিন্ন ধরণের কারুকাজ এবং মৃৎশিল্পে বুরুন্ডির সাধারণ মানুষ দারুণ হাত পাকিয়েছেন। ঝুড়ি বোনা, মুখোশ তৈরি করা এই দেশের শিল্পকর্মের অনন্য নজির। এই দেশে ঢোল বাজানো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইউনেস্কো মারফৎ বুরুন্ডির এই ঢোল বাজানোটা বিশ্ব স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়াও এই দেশে রয়েছে বাঁশি, জিথার, উমুদুরির মত বেশ কিছু মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট।
আমরা সকলেই আফ্রিকার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কথা জানি। এই মহাদেশের জল, স্থল, অন্তরীক্ষ যেন প্রকৃতি খুব সুন্দর করে এঁকে দিয়েছে। কিন্তু মহাদেশের যাবতীয় সৌন্দর্য কোথায় যেন শুকিয়ে যায়। এই সুবিশাল মহাদেশে হারিয়ে যায় গরিবিয়ানার চরম শোষণে। বাদ পড়েনি আফ্রিকা মহাদেশের ছোট্ট দেশ বুরুন্ডি নিজেও। তবে সত্যি বলতে কি, এই দেশের ভাগ্য যেন আফ্রিকার অন্যান্য দেশের থেকেও অনেকটা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এই দেশের কিনারায় দাঁড়িয়ে আমরা হয়ত মনে করি, না-জানি ঐ দেশে কত সুখ লুকিয়ে আছে; ভাবুন তো বুরুন্ডির মানুষজনের কথা! আজকের প্রতিবেদন শেষ করব রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি দিয়েঃ নদীর এপাড় কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস/ ওপাড়ে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। নদীর ওপাড় বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে/ কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপাড়ে। আজকের প্রতিবেদনটা বেশ মনখারাপের। কিন্তু এটাই তো সত্যি। আজ বলব না কেমন লাগল প্রতিবেদন। বরং বলব, বিজনেস প্রাইম নিউজের পক্ষ থেকে আমরা চাই পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ সুস্থভাবে নিজের জীবন কাটান। প্রতিটা শিশুর মুখে উঠুক পর্যাপ্ত আহার, প্রতিটা শিশুর কাছে পৌঁছে যাক শিক্ষার আলো। অন্ধকার থেকে জেগে উঠুক গোটা বিশ্ব।
বিজনেস প্রাইম নিউজ
জীবন হোক অর্থবহ