Daily
পান খেতে চান? প্রশ্নটা যে কোন বাঙালিকে করুন দেখি। খুব পানভক্ত না-হলেও ঠোঁটের কোণে হাসি ঝিলিক মারবেই। হিন্দু হোক বা মুসলমান, পান পাতার কদর বিরাজমান। আর হিন্দু ধর্মে তো পান অত্যন্ত শুভ একটা জিনিস। হিন্দু ধর্মের বহু আচার অনুষ্ঠান পান পাতা ছাড়া অসম্ভব। তা পানপ্রিয় বাঙালির সেই কদর যত দিন গিয়েছে ম্লান হতে শুরু করেছে। কারণ পানের বদলে এখন মানুষের মুখে উঠছে গুটখা। যা কোনদিক থেকেই পানের বিকল্প হতে পারে না। গুটখা খাওয়া মানে, কত না ব্যাধিকে আপ্যায়ন করা শরীরে। মানে সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করা। তা নেশা যে করে, সে তো আর এসব কিছুই বোঝে না। অতএব যা হবার তাই হচ্ছে। দিনে দিনে পানের কদর কমছে। সেটা সটান প্রভাব ফেলছে পান ব্যবসায়। আর পান ব্যবসার ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারের দিকে এগোচ্ছে, তাতে পান ব্যবসায়ীর আশঙ্কা, আর হয়ত কয়েক বছর। তারপর না পান ব্যবসাটাই উঠে যায়! শুনে অবাক হচ্ছেন তো? এটাই কিন্তু অনেকে সত্যি মনে করছেন। তাঁদের ধারণা গুটখার দাপট এমনই বাড়ছে যে পান ব্যবসার ভরাডুবি আর কেউ আটকাতে পারবে না। যদি বিশ্বাস না-হয়, তাহলে আপনাদের জন্য এই প্রতিবেদন।
পান চাষে সুপ্রসিদ্ধ আমাদের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা। বাংলা, কালী বাংলা, মিঠা, সাচী- মূলত এই চার ধরণের পান এখানে ভালোরকম উৎপাদিত হয়। ময়না, তমলুক, নরঘাট, নন্দীগ্রাম, খেজুরি, হলদিয়ায় পানের চাষ যেন সবদিক থেকেই টেক্কা দেয় অন্যান্য চাষকে। না-হলে শুধু পান-কে কেন্দ্র করেই তমলুক মহকুমাতে ১৬টি পানের বাজার তৈরি হওয়া সম্ভব? কিন্তু ভাবুন এই সুবিশাল বাজারের যা ব্যস্ততা আপনারা দেখছেন, এই ব্যস্ততা কিন্তু আগের থেকে অনেকটাই কম। প্রথমে লকডাউনের প্রভাব। তারপর মন্দার বাজার। ফলে দেশে বিদেশে চলে যাওয়া পানের চাহিদা তলানিতে এসে ঠেকছে। আর এই শূন্যস্থানটি দখল করে নিচ্ছে গুটখা। ফলে পান ব্যবসার ভবিষ্যৎ অন্ধকারে। একইভাবে পান চাষিরাও যেন পড়েছেন আতান্তরে। এই বিষয়ে নিমতৌড়ির রামকৃষ্ণ পান ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সম্পাদক পার্থপ্রতিম জানা কি বললেন, শুনে নেওয়া যাক।
তার মানে ভাবুন। আজ যে পান ব্যবসার সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষের পেট জড়িয়ে, সেই ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে যদি আশঙ্কা প্রকাশ করেন খোদ ব্যবসায়ীরাই, তাহলে অদূর ভবিষ্যতের পরিণতি ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে কল্পনা করতে পারছেন? তাঁর বক্তব্য, উত্তরবঙ্গের ইসলামপুর হোক বা বিহারের পূর্ণিয়া- এমন বেশ কিছু বড় বড় পানের মার্কেট ছড়িয়ে ছিল দেশজুড়ে। আজ সেগুলোর কোনটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বা কোনটা বন্ধ হবার মুখে।
পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তারপর চাষিরা মনে করছেন পান চাষ যেন দিনে দিনে ঢাকের দায়ে মনসা বিকনোর মত হতে চলেছে। চাষের খরচ আজ বেড়েছে। পানের বরজ করতে গেলে যে টাকা খরচ হচ্ছে, পান চাষের পর সেই টাকাটা নাকি উঠছে না। লাভের অঙ্ক তো দূর কী বাত। এছাড়া বাঁশ, পাকড়ির খরচ রয়েছে। শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। একদিকে চাষের জন্য খরচের ঠ্যালায় অবস্থা খারাপ। তারপর আবার যদি পানের ব্যবসা মার খায়, তাহলে তো পান চাষ থেকে আগ্রহ তাঁরা হারাবেনই। আগে যেখানে বরজ করতে খরচ হত ৫ হাজার টাকা মতন, আজ সেখানে খরচ হচ্ছে ২০ হাজার টাকা। তাই পান চাষিদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার মত অবস্থা। বাধ্য হয়ে তাঁরা কী বলছেন জানেন?
অনেক পান চাষি রয়েছেন যারা আজ পানের বরজ নষ্ট করে দিচ্ছেন। শুধু পান চাষিরাই নন। ভেবে দেখুন পানকে আশ্রয় করেই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। একে বাজারে দাম নেই, তার ওপর বাড়ছে বরজের প্রতিটি উপকরণের দাম। সব মিলিয়ে তারা নাজেহাল। এই হাট বিগত চল্লিশ বছর ধরে রমরমিয়ে চলছিল। সপ্তাহে পাঁচ দিন বাজার বসত এখানে। কিন্তু বর্তমান ব্যবসার যা হাল, তাতে বর্তমানে তিনদিন এই হাটে একসঙ্গে জরো হন এতো এতো পান চাষি এবং ব্যবসায়ীরা। এখানকার পান চলে যায় অসম, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, কর্ণাটক, পঞ্জাব সহ প্রায় গোটা ভারতে। এছাড়া এখানকার পান দেশ ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে বিদেশেও। তার মধ্যে একটা বড় অংশ যায় বাংলাদেশ, আরব দুনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, লন্ডন সহ বিভিন্ন দেশে। প্রতিদিন কত পান বিক্রি হয় এখানে? কতজনই বা জড়িয়ে রয়েছেন?
পার্থপ্রতিম জানা আরেকটা অভিযোগ করেছেন। তাঁর বক্তব্য পান ব্যবসার সঙ্গে রেল তেমন একটা সহযোগিতা করছে না। আর সহযোগিতা না করাটাই পান ব্যবসার অন্যান্য ক্ষতিগুলোর মধ্যে সেটাও একটা বড় কারণ বলে মনে করছেন তাঁরা। রেলের অসহযোগিতা কী নিয়ে, সেটাও শুনে নিন।
গুটখার দাপট আজ অব্যাহত। এদিকে পানের প্রতি আগ্রহ নিচের দিকে, সেটা সর্বত্র। সব মিলিয়ে আজ কিছুটা দিশাহিন বলা যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে পান চাষিরা সরকারকে পাশে চাইছেন। সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে করছেন তাঁরা। না-হলে পান চাষিদের আশঙ্কা যে অমূলক নয়, সেটা তো আগেই স্পষ্ট হয়ে গেল। প্রতিবেদনটি যত পারবেন শেয়ার করুন। গুটখার দাপট বন্ধ করুন। পান চাষে আগ্রহ ফিরে আসুক চাষিদের।
সুব্রত সরকার
পূর্ব মেদিনীপুর