Trending
দূর থেকে যাহা চকচক করে, তাহাই কিন্তু সোনা নয়। কেন বললাম? ২০২৩ এর বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন। শুরু হচ্ছে আজ থেকে। দেশ, বিদেশ থেকে তাবড় শিল্পপতিরা আসবেন এই সম্মেলনে। যেমন প্রত্যেকবার এসে থাকেন। তাঁরা কত কি বিনিয়োগ করলেন? সেটা আমরা সাধারণ মানুষরা বুঝতে পারি না তেমন, কেন কে জানে? তবে বাংলার সরকার নাকি একেই রাজ্যের মেগা ইভেন্ট বলে। যে ইভেন্ট গোটা দেশকে দেখিয়ে দিতে পারে, ইকোনমিতে বাংলা এখন কতটা পোক্ত। যে ইভেন্ট দেখিয়ে দেয়, দেশের ফিউচার ব্লুপ্রিন্ট যদি কোথাও থেকে লেখা হয় তাহলেও সেটা বাংলা থেকেই। বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন- নামটাই বলা যেতে পারে মার দিয়া কেল্লা। কিন্তু বিরোধী দলগুলো যে বলছে, এসব পুরো আইওয়াশ। কারণ বাংলার রিপোর্ট কার্ডে শিল্প, উন্নয়ন এসব একেবারে গোল্লায়। সত্যি কি তাই? চলুন, সেদিকে আজ একবার তাকানো যাক।
মঙ্গলবার মানে আজ বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিউ টাউনের বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে। আর বুধবার অনুষ্ঠান হবে ধনধান্য অডিটোরিয়ামে। প্রায় ৩০টির মত দেশ অংশ নিতে চলেছে এই সম্মেলনে। এই তো সেপ্টেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘুরে এলেন স্পেন এবং দুবাই থেকে। মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, দুবাই। সেখানেও লক্ষ্য ছিল বিনিয়োগকারীদের নিয়ে আসা বাণিজ্য সম্মেলনে। কারা কারা উপস্থিত থাকতে পারেন? রিলায়েন্স কর্ণধার মুকেশ অম্বানি, দুবাই-এর লুলু গ্রুপের আধিকারিক, আরপিএসজি গ্রুপের চেয়ারম্যান সঞ্জীব গোয়েঙ্কা, আইটিসি গ্রুপের সঞ্জীব পুরী, চ্যাটারজি গ্রুপের পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়, সজ্জন জিন্দল, আইটিসি, মাহিন্দ্রা অ্যান্ড মাহিন্দ্রা, হিন্দুস্তান ইউনিলিভার, নেওটিয়া গ্রুপের মত জায়ান্ট সংস্থাগুলোর শিল্পপতিরা। এছাড়া তো ইংল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, আমেরিকা, জার্মানির মত ৩০টি দেশের প্রতিনিধি দল। আর ইনভাইটেড থাকছেন আদানি। ব্যস…এখানেই যেন তাল কেটে গেল একটু। আদানির সঙ্গে টিএমসি-র সম্পর্ক কেমন? সেটা আমরা জানি না। তবে এটা জানি যে, আদানি গোষ্ঠী আর মহুয়া মৈত্রের মধ্যে একটা দড়ি টানাটানি চলছে। যে দলের সাংসদ বারবার আদানি-মোদীর মধুর রসায়নকে তুলোধোনা করছেন, সেই দলের সাংসদের কথাটা কি তাহলে তৃণমূল গায়ে মাখতে রাজি নয়? অবশ্য সাংসদ মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এই পুরো কাজটি করেছেন নাকি টাকা নিয়ে। খসড়া রিপোর্ট পেশ করেছে এথিক্স কমিটি। প্রস্তাব আনা হয়েছে মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজের। যাকে নিয়ে এতো হুজ্জুতি, তাকেই আবার কেন ডাক পাঠানো? মন্ত্রী শশী পাঁজা অবশ্য পলিটিক্স আর ইকোনমিক্স দুটোকে আলাদা ট্র্যাকে বসিয়ে দিয়েছেন। উন্নয়ন উন্নয়নের জায়গায়, রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়। উন্নয়নে রাজনীতি বাধা পাক, সেটা কোনভাবেই কাম্য নয়। তাজপুরে বিশাল বন্দর তৈরি হবে। সেটা আদানি গ্রুপ তৈরি করছে। সত্যিই তো এই মুহূর্তে আদানি ছাড়া আর করবেই বা কে? অতএব, যতই মুখে মারিতং জগত বলি না কেন, বাংলায় ব্যবসা আনার জন্য গ্রিন কার্পেট আদানিদের জন্য থাকছেই। মনে করা হচ্ছে, দেশ-বিদেশ সব মিলিয়ে ১ হাজার ডেলিগেটস উপস্থিত থাকতে পারেন এই বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে।
তা এবারের বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে কোন কোন সেক্টরে নজর দিচ্ছে সরকার?
ছোট, মাঝারি শিল্প বা এমএসএমই সেক্টর
কৃষি
আইটি
পরিকাঠামো উন্নয়ন
পর্যটন
স্বাস্থ্য
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
শিক্ষা কারিগরি
ক্রিয়েটিভ ইকোনমি
ইকোনমিক করিডোর, করিডোর সংযোগকারী রাস্তা, বিমানবন্দর
বিদ্যুৎ
আর ডেউচা পাচামি কয়লা খনি প্রকল্প
তালিকা লম্বা। সুতরাং বিনিয়োগটাও বেশ লম্বা হওয়া প্রয়োজন। এবারের বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন থেকে রাজ্যে বিনিয়োগ আসতে পারে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ কোটি টাকা। গতবারের বিজিবিএসে বিনিয়োগের প্রস্তাব মেলে ৩.৪২ লক্ষ কোটি টাকা মতন। এবারে আশা বেড়েছে বলেই না বিনিয়োগের অঙ্কটা বাড়ানো গিয়েছে। এতো পরিমাণ বিনিয়োগ যদি সত্যি আসে তাহলে কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গ আর এড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না। কারণ কাজের এমন সুযোগ তৈরি হবে যে ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া বাংলার ছেলে-মেয়েরাও ফিরে আসতে পারে আপন ঘরে এবং কাজ করতে পারে। এখানে বিজনেস এনভায়রনমেন্ট রয়েছে। আর নিজের রাজ্যে যখন কাজের পরিবেশ তৈরি হয়ে যাবেই, তখন অন্য কোথাও যাবার আর প্রয়োজন কী? এই যেমন লুলু গ্রুপের কথা ধরা যাক। শুধু কলকাতা বলে নয়, কলকাতা সংলগ্ন বিভিন্ন জেলাতেও নাকি এই গ্রুপ বিনিয়োগ করতে পারে। নিউ টাউনে বিশ্বমানের মল তৈরি করবে লুলু গ্রুপ। এছাড়া কলকাতা সংলগ্ন অন্যান্য জেলাতেও বিনিয়োগ করবে তারা। আর বিনিয়োগ মানেই তো এমপ্লয়মেন্ট। সিআইআই একটা রিপোর্ট পেশ করে জানিয়েছে, স্বাস্থ্য পরিষেবা খাতে ২৬টি মউ সাইন হবার কথা। সেখান থেকে মোট বিনিয়োগ আসতে পারে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি মতন। এডুকেশন সেক্টরে মউ সাইন হতে পারে ৫৯ টা। মাধ্যমিক স্তরে বিনিয়োগ আসতে পারে ১৬০০ কোটি, হায়ার এডুকেশনে ইনভেস্টমেন্ট আসতে পারে ৩ হাজার কোটি। এমএসএমই খাতে মউ সাইন হতে পারে ১৫টা মতন। এছাড়া তো অন্যান্য সেক্টরেও নাকি বিনিয়োগ নিয়ে দুর্দান্ত আশাবাদী রাজ্য সরকার। আর এখানেই প্রত্যেকবারের মত তাল কেটে দিচ্ছেন অপোজিশন পার্টিগুলো। বিরোধীদের সাফ বক্তব্য, মমতা যা বলছেন, আর বাণিজ্য সম্মেলন করে মমতা যা দেখাতে চেয়েছেন আসলে সেগুলো নাকি পুরোটাই আইওয়াশ! তাদের বক্তব্য, ঘটা করে শিল্পপতিদের ডাক দিয়ে বাংলায় নিয়ে আসাটুকুই শুধু হয়েছে। আনএমপ্লয়মেন্টের গ্রাফ এখনো চড়া, কাজের বাজার প্রায় নেই। মানে শিল্পপতিরা আসছেন, শুধু শিল্পটাই আসছে না। বিরোধীদের বক্তব্য, এতো শিল্প করতে গেলে তো জমি চাই। তা বর্তমান রাজ্য সরকারের জমিনীতিই নাকি ঘেঁটে আছে। যে কারণে কোন শিল্প হচ্ছে না। তৃণমূল সেই দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছে। তারা বলছে, রাজ্যে শিল্প না এলে ইকোনমি মজবুত হবে কী করে? তার মানে তো জোর করে জমি কেড়ে শিল্প নয়। এই স্ট্যান্ডপয়েন্টে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সঙ্গে এটাও বলেছেন, ১২ বছরে দেশে বেকারত্বের হার যখন বেড়েছে, তখন রাজ্যে বেকারত্ব কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এছাড়াও রাজ্য সরকার বলছে, গত বিজিবিএস থেকে ট্যুরিজম সেক্টরে নাকি দুর্দান্ত জাম্প লক্ষ্য করা গেছে। রিয়েল এস্টেট সেক্টরেও লক্ষ্য করা গেছে সেই বুম।
বাংলা সম্ভাবনার জায়গা। বাংলা বিনিয়োগের জায়গা। আর এমএসএমই সেক্টরকে পাখির চোখ করে এবারে কোমর বেঁধে নামছে আমাদের বাংলা। এই গোটা ইভেন্টের পৌরোহিত্য করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিনিয়োগ যা হবে আদৌ কি সেটা বাস্তবে রূপায়িত হবে? এই প্রশ্ন আগেও তুলেছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। এবারে সেই দিকটা কতটা ফিলআপ হবে? বাংলা মানেই ব্যবসা, বাংলা মানেই বিনিয়োগ। সেই বাংলার ভবিষ্যৎ এঁকে দেবার জন্যই এই বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন। তাই আশা ছাড়বেন না। বাংলা এগিয়ে চলুক। বাংলার অর্থনীতি সমৃদ্ধ হোক। কাজ খুঁজতে বাংলার মানুষকে ভিন রাজ্যে যাবার প্রয়োজন কমে আসুক। বরং বাংলায় অন্য রাজ্য থেকে মানুষেরা আসুক কাজের খোঁজের জন্য। মানে, শিল্পপতিদের সঙ্গে শিল্প আসুক বাংলায়। কী বলেন? মতামত জানান কমেন্ট বক্সে। সঙ্গে লাইক করুন, শেয়ার করুন। আর সাবস্ক্রাইব করুন বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ