Tech-Talk
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, বাংলাদেশের প্রথম জিওস্টেশনারি কমিউমিকেশন অ্যান্ড ব্রোডকাস্টিং স্যাটেলাইট। যার হাত ধরে বাংলাদেশের ইতিহাসে মহাকাশের দরজা খুলে যায় চিরতরে। ২০১৮ থেকে ২০২২- এই চার বছর ধরে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট শুধু বাংলাদেশ বলেই নয়, আরও বেশ কয়েকটি দেশে মিডিয়া সংস্থার হাত ভালোভাবে ধরতে পেরেছে। বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট যখন উৎক্ষেপণ করা হয়, সেই সময় বাংলাদেশ সরকারের এই পদক্ষেপ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তারপর অবশ্য অনেকেই বলতে থাকেন, আসলে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেও বাংলাদেশ নিজের কোষাগারে কোনরকম অর্থ ঢোকাতে পারে নি। সত্যিই কি তাই? বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কি তাহলে বাংলাদেশের একটি ফেল্ড প্রোজেক্ট? আসুন, আজকের প্রতিবেদনে এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাক। সঙ্গে বলা যাক বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কিভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের ভাবনাচিন্তা প্রথম নিয়ে আসে বিটিআরসি বা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন। ২০০৯ সালে সেই ভাবনায় সিলমোহর পড়ে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য ইলেকট্রনিকের আবেদন জানানো হয় স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনালের কাছে। এরপর আসে স্যাটেলাইট সিস্টেম কেনার পালা। এগিয়ে আসে ফ্রান্সের সংস্থা থ্যালাস অ্যালেনিয়া স্পেস। বিটিআরসি-র সঙ্গে চুক্তি হয় ১ হাজার ৯৫১ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকার। ২০১৫ সালে বিটিআরসি রাশিয়ার সংস্থা ইন্টারস্পুটনিকের কাছে অরবিটাল কক্ষপথ কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। এখানেই বলি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ২০১৮ সালের ১১ মে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। বিটিআরসি-র সঙ্গে ফ্যালকন ৯ ব্লক ৫ রকেটেরও এটি প্রথম পেলোড উৎক্ষেপণ ছিল। জানিয়ে রাখি, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নির্মাণ এবং ২০১৮ সালে উৎক্ষেপণের জন্য খরচের অঙ্ক পৌঁছে গেছিল ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায়। যার মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে বেরিয়েছিল ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা মতন। এছাড়া বিডার্স ফাইন্যান্সিং-এর মাধ্যমে বাকি অর্থ জোগানের ভাবনাচিন্তা করা হয়। ২০১৬ সালে এগিয়ে আসে এইচএসবিসি। জানানো হয়, বাকি টাকা দেবে এই সংস্থা। তার জন্য ১২ বছরে ২০ কিস্তিতে সেই ধার পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। প্রথমে বলা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের জীবনকাল ১৫ বছর। তারপর অবশ্য আরও ৩ বছর বাড়ানো হয়। অর্থাৎ ১৮ বছর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশ থেকে নিজের কাজ মসৃণভাবে করতে পারবে। ৩.৭ টন ওজনের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি।
পড়শি দেশের কিছু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ব্যর্থতা আগুনে ঘি ঢেলেছিল। কারণ, সেই সময় বেশ কিছু জায়গায় বলা হয় যে এত খরচ-খরচা করে পরিশ্রম করে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানো তো হল। কিন্তু তিন বছরে একটি টাকাও নাকি আয় করতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার। তবে এই তথ্য যে পুরোটাই ভুল, সেই বিষয়ে নিশ্চয়তা দেয় বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি। এই তিন বছরে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সত্যিই বাংলাদেশের অর্থনীতির উত্থানের জন্য বন্ধুত্বের মর্যাদা রেখেছে। কারণ, তিন বছরে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে আয়ের অঙ্ক এসেছে ৩০০ কোটি টাকা মতন। অঙ্কটা আরেকটু বেশি হলেও হতে পারে। বাংলাদেশে প্রকাশিত কিছু তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, স্যাটেলাইটের দরুন প্রতি মাসে ১০ কোটি টাকা আয়ের মুখ দেখছে বাংলাদেশ।
আসলে, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মত সাহসী পদক্ষেপ রাখতে গেলে বিভিন্ন ধরণের বিরোধিতা তো আসবেই। তাই বলে পিছিয়ে থাকলে তো আর চলবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিয়ে যেন বেশ কিছু বাধা এসেই যাচ্ছিল। রোজগারের কথা যেমন বললাম, তেমনি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সময়েও বারবার ধাক্কা খেয়েছে। যেমন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য প্রথম ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। যেহেতু এই স্যাটেলাইটটি ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দেখা যায়, হারিকেন ইরমার এসে পড়ায় ফ্লোরিডা ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে। ফলে পিছিয়ে দেওয়া হয় উৎক্ষেপণের তারিখ। এরপর ৪ মে ২০১৮ সালে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকেই দুই পর্যায়ে স্ট্যাটিক ফায়ার টেস্ট করা হয়। এরপর ঠিক হয় ১০ মে তারিখে লঞ্চ করা হবে। কিন্তু কারিগরি কিছু সমস্যা দেখা যাওয়ায় ফের থমকে যায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণ। অবশেষে ১১ মে মহাকাশের উদ্দ্যেশে রওনা দেয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। ১২ মে থেকে বাংলাদেশ সিগন্যাল পেতে শুরু করে। আজ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৩৮টি চ্যানেল, বাংলদেশ রেডিও। এই দেশের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী এই স্যাটেলাইটের সাহায্য পুরোমাত্রায় নিচ্ছে। একইসঙ্গে স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশের দুর্গম কিছু এলাকায়। তবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট শুধু বাংলাদেশ বলেই নয়। সাহায্য করছে আন্তর্জাতিক স্তরেও। হন্ডুরাসের ২টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল, তুরস্কর ১টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল, ফিলিপাইনের ১টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল, ঘানার ২টি টিভি চ্যানেল, সাউথ আফ্রিকার ২টি অনলাইন ভিত্তিক টিভি চ্যানেল এই স্যাটেলাইটের পূর্ণ সহযোগিতা পাচ্ছে।
কথায় বলে, সব ভালো যার শেষ ভালো। সত্যিই তো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট যেভাবে বাংলাদেশ সরকারকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য ক্রেডিট যাবে শুধু বাংলাদেশের কাছেই। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অবস্থান ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমায়। আর সেখান থেকেই বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশের কাছে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে রেখেছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। প্রতিবেদন শেষ করার আগে আর একটা কথা। কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে বাংলাদেশ ৫৭ তম দেশ হিসেবে ঢুকে পড়েছে তালিকায়। যাই হোক, পুরো প্রতিবেদন দেখার পর আশা করি সবাই বুঝতে পারছেন, বেশ ভালোই রয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ