Trending
আন্দামান-নিকোবর- জল, জঙ্গল এবং আদিবাসী মানুষের বাসস্থান। অন্তত জায়গাটার নাম মুখে আনলে এই দৃশ্যগুলোই চোখের সামনে উঠে আসে। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে, এই আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জই নাকি বদলে দিতে চলেছে ভারতের ভাগ্য। মনে করা হচ্ছে, অয়েল রিজার্ভ নিয়ে ভারতকে নাকি আগামী ৭০ বছর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। সত্যি কি তাই? চলুন, আজকের প্রতিবেদনে আলোচনা সারা যাক, কিভাবে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতের ভাগ্য পুরোপুরি বদলে দিতে পারে।
আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে বলা হয় বিশ্বের মোস্ট স্ট্র্যাটেজিকালি লোকেটেড আইল্যান্ড চেন্স। সিকিওরিটির পাশাপাশি ভারতের ইকোনমি এবং এনার্জির মত সেক্টরে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছাপ রাখতে চলেছে। তার জন্য আগে ঝালিয়ে নেওয়া যাক আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান। বে অফ বেঙ্গল বা বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণে ৮ হাজার ২৪৯ কিমি জায়গা জুড়ে অবস্থিত আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। যেখানে দ্বীপের সংখ্যা ৮৩৬। কিন্তু এতোগুলো আইল্যান্ডের মধ্যে মাত্র ৩৮-টি আইল্যান্ডে প্রায় সাড়ে চার লক্ষের মত মানুষ বসবাস করেন। এই দ্বীপপুঞ্জের একেবারে উত্তরের দিক মায়ানমার থেকে ২২ নটিক্যাল মাইল এবং দক্ষিণের পয়েন্ট মানে ইন্দিরা পয়েন্ট ইন্দোনেশিয়া থেকে ৯০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থিত। আর এটি অবস্থিত স্ট্রেট অফ মালাক্কার পশ্চিমপ্রান্তে। সত্যি বলতে কি, এটাই ওয়ার্ল্ডের ওয়ান অফ দ্য বিজিয়েস্ট ট্রেড রুট বলা যেতে পারে। এখান দিয়ে যাতায়াত করে প্রতিদিন প্রায় ৬০ হাজারের বেশি কমার্শিয়াল ভেসেল। আন্দামান নিকোবর ভারতের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের ৩০% শেয়ার করে। কারণ এখানেই রয়েছে রিসোর্সের ভাণ্ডার। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এতোকিছুর পরেও আন্দামান নিকোবর ডেভেলপ করার জন্য ভারত সরকার কোনভাবেই মাথা ঘামায় নি। সেই বিষয়ে একটা আন্দাজ আপনাদের দিচ্ছি।
কয়েক বছর আগের কথাও যদি ধরি, তাহলে দেখব আন্দামান নিকোবর আইল্যান্ডের মাত্র ৭ শতাংশ এরিয়া ডেভেলপড ছিল। আর বাকি পুরোটাই ছিল সংরক্ষিত এরিয়ার মধ্যে। স্বাভাবিকভাবেই, দ্বীপপুঞ্জে কত যে অমূল্য রতন রয়েছে সেই খোঁজে আর বিশেষ গা ঝাড়া দেয়নি ভারত সরকার। কিন্তু কতদিন আর এই অবহেলা চলবে? এলাকার ইম্পরট্যান্স বুঝে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে ভারত সরকার। আজকের জিও পলিটিক্স এবং গ্লোবাল ইকোনমির যে বিশ্বজনীন পটবদল চলছে, সেখানে ইন্দো-প্যাসিফিক এরিয়া এবং তার মধ্যে ইন্ডিয়ান ওশান বা ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব দিন দিন বেড়েছে। রাশিয়া-আমেরিকার যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলেছিল, তারপর এই এলাকাটি খানিক ঝিমিয়ে থাকলেও এখন আর সেটা নেই। আর ভারত সরকার সেটা বুঝতে পেরে ম্যাসিভ কিছু চেঞ্জেস নিয়ে আসছে। কিরকম? ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতন ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট এই আন্দামান নিকোবর আইল্যান্ডকে মেরিটাইম হাব বানানোর একটা মাস্টার প্ল্যান দেয়। তার জন্য সরকার প্রায় ১০ কোটি টাকার একটা প্রোজেক্ট অ্যানাউন্স করে। এরপর ২০১৮ সালে যোগাযোগ, এনার্জি এবং ট্যুরিজম সেক্টর নিয়ে বেশ কিছু প্রোজেক্ট প্ল্যানিং তারা করে। ২০১৯ সালে শুরু করা হয় ল্যান্ড রিক্লেমেশন প্রোজেক্ট। এটা শুরু হয় আইল্যান্ড কোস্টাল রেগুলেশন জোনের আন্ডারে। যেখানে পোর্ট এবং হারবার বানানোর কথা জানানো হয়। এছাড়াও ৫ হাজার কোটি টাকার একটি ডিফেন্স প্ল্যান নিয়ে আসে ভারত সরকার। এরপর ২০২০ সালে চেন্নাই-আন্দামান অ্যান্ড নিকোবর আন্ডার সি ইন্টারনেট কেবল বসানোর কাজ শুরু হয়। স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট হিসেবে ধরলে, এই জায়গার ডেভেলপমেন্ট নিয়ে অনেক আগেই ভাবা উচিৎ ছিল সরকারের। যেটা গত কয়েক বছরে বেশি মাত্রায় নজরে পড়ছে। কিন্তু এসব ছাড়াও আরেকটা কারণ হল তেল। যা আগামী ৭০ বছরের জন্য ভারতের ভবিষ্যৎ একেবারে বদলে দিতে পারে। কিরকম?
ভারত এনার্জি কনজিউম করার দিক থেকে রয়েছে তিন নম্বরে। কিন্তু নিজের দেশে এনার্জি তৈরিতে ভারত চিরকালই অভাগা। আর যে কারণে চাহিদা মেটাতে ভারতকে নির্ভর করতে হয় খুব বড় মাত্রায় আমদানির জন্য। আর তেলের কথা যদি ধরি, তাহলে ভারত তেল আমদানির দিক থেকে রয়েছে একেবারে ফ্রন্টফুটে। তেল মন্ত্রকের পেট্রোলিয়াম প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যানালিসিস সেলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ভারতের ক্রুড অয়েলের ওপর নির্ভরতা পৌঁছে যায় ৮৭.৩ শতাংশে। ২০২১-২২ সালে যেটা ছিল ৮৫.৫ শতাংশ। ২০২০-২১ সালে যেটা ছিল আরও কম- ৮৪.৪ শতাংশ মতন। শুধু ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ভারত ক্রুড অয়েল আমদানি করে ২৩২.৪ মিলিয়ন টন। তার জন্য খরচ হয় প্রায় ১৫৮.৩ বিলিয়ন ডলার মতন। কোভিড, তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আর এখন ইজরায়েল-হামাসের যুদ্ধ। খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছেন যে, পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তারপর তেলের দাম বিশ্ব বাজারে কোথায় পৌঁছতে পারে সেটা নিয়ে তীব্র একটা দোলাচল থেকেই যায়। আর এই বিশাল অঙ্কের তেল আমদানি করতে গিয়ে ভারতের ফরেক্স রিজার্ভে ভালোরকম চাপ পড়ে। সেটা আবার ইন্ডিয়ান ইকোনমির জন্য ফাঁড়া তৈরি করতে পারে। এমনকি বাণিজ্য ঘাটতি, ইনফ্লেশন এসব কিছু হবার চান্সও অনেকটা বেড়ে যায়। তার জন্য ভারত নিজের দেশেই ক্রুড অয়েলের উৎপাদন বাড়ানোর কথা ভাবছে। আর সেখানেই মসিহা হয়ে দাঁড়াতে পারে আন্দামান-নিকোবর। কেন?
আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ডিপ সি এক্সপ্লোরেশন করা হচ্ছে। এই সার্ভে শুরু হয় গত বছর নভেম্বরে। কাজ শুরু করে ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ হাইড্রোকার্বনস, স্পেস ডিপার্টমেন্ট, ন্যাশনাল সেফটি কাউন্সিল। কারণ, মনে করা হচ্ছে এই এলাকায় ১৭ বিলিয়ন টন তেল এবং গ্যাস মজুদ রয়েছে। যার মধ্যে ৭.৪ বিলিয়ন টন ডিসকভার করা গিয়েছে। এই তেলের ভাণ্ডার কত জানেন? আগামী ৭০ বছরের জন্য ভারতকে আর তেল নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। কিন্তু কিভাবে এতো তেলের মজুদ? আন্দামান নিকোবর আইল্যান্ডের ভৌগলিক এলাকার সঙ্গে ম্যাচ করে মিডল ইস্টের অয়েল রিজার্ভের সঙ্গে। সৌদি আরবের ক্রাস্টাল প্লেট রয়েছে ইরান ক্রাস্টাল প্লেটের নিচে ঢুকে রয়েছে। আর যে কারণে ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ম্যাগমা এখানে তৈরি হয়। আর কেমিক্যাল রিঅ্যাকশনের জন্য এখানে প্রচুর পরিমাণে তেল এবং গ্যাস পাওয়া যায়। আন্দামান নিকোবরের ক্ষেত্রেও তাই। এখানেই ইন্দো অস্ট্রেলিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের মধ্যে ঢুকে রয়েছে। আর সেই একই কারোনের জন্য আন্দামান নিকোবর আইল্যান্ডের আশেপাশে তেল এবং গ্যাসের ভান্ডার রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
আন্দামান নিকোবর আইল্যান্ড থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকার সময় শেষ। চিনকে চাপে ফেলতে তো বটেই এমনকি গ্লোবাল এরিনায় যদি ভবিষ্যতে কোন সংকট তৈরি হয় তাহলে এনার্জি ক্রাইসিস হবার মত পরিস্থিতি তৈরি হলেও নিজেকে বাঁচাতে পারবে ভারত। আপনার কি মনে হয়? মতামত জানান কমেন্ট বক্সে। সঙ্গে লাইক করুন, শেয়ার করুন আমাদের প্রতিবেদন। আর নতুন হলে সাবস্ক্রাইব করে নিন বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ