Daily
সোনার ফসল ফলায় যে তার/ দুই বেলা জোটে না আহার। মনে পড়ছে সত্যজিৎ রায়ের সেই বিখ্যাত লাইন! মাটি উর্বর, চাষযোগ্য হলে না-হয় সোনার ফসল ভালোভাবেই ফলানো যায়। কিন্তু চাষের মাটি যদি অনুরবর হয়, জলের ফ্লো নিয়ে থাকে গভীর দুশ্চিন্তা, খরাপ্রবণ তেমন এলাকা হলে কি সেই মাটিতেও সোনার ফসল ফলানো সম্ভব? পুরুলিয়ার মাটির যা চরিত্র, তাতে হয়ত বিষয়টা প্রাথমিক পর্যায়ে আকাশকুসুম কল্পনা বলেই মনে হতে পারে। জলে জোগান কম। বেশিরভাগ জমিতে জলের অভাবে বড়জোর একবার মাত্র চাষ। আর উঁচু জাতের জমি হলে বছরভর জমি পতিত হিসেবে পড়ে থাকা, এটাই পুরুলিয়ার এগ্রিকালচারাল ট্র্যাডিশন। কিন্তু এই ধরণের জমিতেও যে সোনার ফসল ফলানো সম্ভব সেটা আজ প্রমাণ করে দেখিয়েছেন পুরুলিয়ার কৃষকরা। কিভাবে, সেটাই বলব।
এমনিতেই পুরুলিয়ার কৃষকদের মধ্যে চাষবাসে এক ব্যপক অনিহা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। তার পেছনে বেশ কয়েকটা কারণ রয়েছে। যেমনঃ সঠিক মূল্যে উন্নতমানের বীজের অভাব, বর্তমান সময়ে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির বিষয় সঠিক ধ্যানধারণা না-থাকা, এমনকি উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সঠিক মূল্য না-পাওয়া। ফলে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর কৃষকদের হাতে আশানুরূপ আয় কোথায়? স্বাভাবিকভাবেই, দিনের পর দিন এই ট্র্যাডিশন বজায় থাকার কারণেই কৃষি বিমুখ হয়ে পড়ছিলেন অনেকেই। চাষবাস ছেড়ে অন্যান্য কাজে মন দিচ্ছিলেন। তারপর এলো অতিমারির থাবা। এই সময়, অনেকেই আবার কর্মহীন হয়ে পড়লেন। সবমিলিয়ে ভবিষ্যৎ যেন বেশ টালমাটাল হয়ে পড়েছিল। এমনই একটি সময়ে ২০২১ সালে, পুরুলিয়ার জয়পুর ব্লকে তৈরি করা হল মানভূম ফার্মার্স প্রোডিউসার কোম্পানি। তাদের উদ্দ্যেশ্য কী? জেলার কৃষিজীবী মানুষের মধ্যে নতুন করে চাষবাসে উৎসাহ জোগানো। মানুষকে ফের স্বনির্ভর করে তোলা। একইসঙ্গে কৃষকদের চাষবাসে উৎসাহিত করা। ফলে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার একটা দিশা দেখতে পেলেন অনেকেই। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ডব্লিউবিসিএডিসি সাহারজোড় প্রকল্পের উদ্যোগে মনরেগা-র মাধ্যমে প্রদর্শনী এলাকার ১২০ বিঘা জমিকে সমতল করে চাষের উপযুক্ত করা হোল। আর সেখানেই তৈরি করা হোল বিরাট আমের বাগান। একইসঙ্গে চাষ করা হোল তরমুজ।
আসলে যে আমের বাগান তৈরি করা হয়েছিল, সেই আমগাছগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ফাঁকা জমি ছিল। সেই ফাঁকা জমিগুলিকেই ব্যবহার করা হয়। উৎপাদনমুখী করে তুলতে এখানকার প্রায় ৪০ বিঘে এলাকায় গত বছর গ্রীষ্মকালে চাষ শুরু হয় তরমুজ সহ বিভিন্ন সব্জির। যার মধ্যে ৩০ বিঘে জমিতে চাষ করা হচ্ছিল তরমুজের। খুব কম পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহার করে এবং জৈব সারের উপর নির্ভরতা বাড়িয়ে পাওয়া গিয়েছে সাফল্য। কিন্তু এখানে তো জলের অভাব রয়েছে। আসল কারিগরি সেটাই। কম জলে কিভাবে চাষ করা সম্ভব? সেটাই করে দেখিয়েছেন মানভূম ফার্মার্স প্রোডিউসার কোম্পানির সদস্যরা।
অযোগ্য জমিকে চাষযোগ্য জমি করে তোলা এবং সেখানে ভালোভাবে চাষবাস করা- সেটা তো মুখের কথা নয়। তাই পুরো বিষয়টা নিজের হাতে তদারকি করেছে ডব্লিউবিসিএডিসি। এখন সেই জমি যখন চাষের উপযুক্ত হল এবং ভোলানাথ মাহাতোর মতন মানুষ তরমুজ চাষে উদ্যোগী হয়ে দুর্দান্ত একটা সাফল্য পেলেন, সেটা এলাকার অন্যান্য কৃষকদের জন্য যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক।
৩০ বিঘা জমিতে তরমুজের চাষ করা হয়। রাসায়নিক সারের ব্যবহার যতটা সম্ভব কমিয়ে জোর দেওয়া হয় জৈব সারের উপরে। বীজ বোনার ৩০ দিন পর রাসায়নিক সার হিসাবে দেড় কেজি করে পটাশ ও ফসফেট জলে গুলে স্প্রে করা হয়েছে। এছাড়াও অনুখাদ্য হিসাবে বোরোন ও জিঙ্ক ব্যবহার করা হয়। ফসলের কীটশত্রু দমনে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে নিমতেল ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া গেছে। আর পুরুলিয়ায় সবথেকে বড় সংকট রয়েছে জল নিয়ে। তাই জলের অপচয় যাতে আটকানো যায়, সেদিকেও রাখা হয়েছে বিশেষ নজর। জলের অপচয় অনেকটা আটকানো সম্ভব হয়েছে আধুনিক পলি মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করার জন্য। আগাছার উপদ্রব কম হয়েছে। কম হয়েছে শ্রমিক খরচ। রোগপোকার আক্রমণও অনেকটা কম হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সোনার ফসল ফলানোর জন্য এই ধরণের উদ্যোগ কার্যত নজির যে তৈরি করেছে, সেটা নিঃসন্দেহে বলাই যায়।
সাফল্য যখন আসে তখন ফিরে আসে আগ্রহ। চাষের সাফল্য দেখে বাকিদের মধ্যেও সেই আগ্রহ দেখা যায়। সার্বিকভাবে আয়ের পথ খুঁজে পান গ্রামের কৃষিজীবী মানুষরা। আর সবথেকে বড় বিষয়, পুরুষদের পাশাপাশি গ্রামের যে সকল মহিলারা কোনদিন ভাবতেও পারেননি যে, এবার তাঁরাও উপার্জন করবেন, সংসার টানার জন্য একটা সুস্থ দিশা খুঁজে পাবেন, আজ সেটা সম্ভব হচ্ছে। সেই কৃতিত্ব সহজেই দাবি করতে পারে মানভূম ফার্মার্স প্রোডিউসার কোম্পানি।
কমদিনের ফসল এই তরমুজ চাষে তুলনামূলকভাবে অন্য ফসলের থেকে একটু বেশি হয়। একর প্রতি খরচ পড়ে প্রায় ৪৫-৫০ হাজার টাকা। বিঘাতে ৫ টন ফলন পেলে এবং ১ হাজার টাকা কুইন্টাল হিসাবে দাম পেলে আয়ের অঙ্ক পৌঁছে যেতে পারে ১.৫০ লক্ষ টাকা। খরচখরচা বাদ দিলে লাভ থাকে ১ লক্ষ টাকা মতন। প্রদর্শনী ক্ষেত্রে এই চাষ দেখে উৎসাহিত হয়ে এবার মোট ১৫০ বিঘা জমিতে প্রোডিউসার কোম্পানির সদস্যরা এই চাষে নেমেছেন। সংস্থার পক্ষ থেকে তাদের চাষের জন্য বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করা হচ্ছে। একইসঙ্গে রুক্ষ জমিতে সোনার ফসল ফলিয়ে আজ গোটা পুরুলিয়া জেলায় কার্যত নজির তৈরি করেছে মানভূম ফার্মার্স প্রোডিউসার কোম্পানি।
সন্দীপ সরকার
পুরুলিয়া