Trending
তালিবানের দখলে চলে যাওয়ার পর থেকেই আফগানিস্তানে ভাগ্য সংকট তৈরি হয়। একের পর এক ফতোয়া জারি করা, বৈদেশিক রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে ঘাটতি তৈরি হওয়া, নারীদের শিক্ষাপ্রসারে দাঁড়ি টেনে দেওয়া- এই সবই আফগানিস্তানকে দাঁড় করিয়ে দেয় একেবারে খাদের কিনারে। আফগানিস্তানের যাবতীয় দায়িত্ব তালিবানরা হাতে নেবার পর থেকেই প্রত্যেকে ধরে নিয়েছিলেন যে, দেশটি যাও বা একটু উন্নতির মুখ দেখার চেষ্টা করছিল, এবার হয়ত সেটা একেবারেই ভেঙে পড়বে। কিন্তু একদিকে যখন পাকিস্তানের অর্থনীতি কার্যত অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে, তখন আরেকদিকে আফগানিস্তান ছোট ছোট পা ফেলে নিজের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে সুপারকার এনে বিশ্ব গাড়িবাজারে নিজেদের একটা ছাপ রাখার চেষ্টা করেছিল, এবার নতুন করে অর্থনীতির দিকটাও যথেষ্ট স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে তারা। অন্তত সেটাই বলছে বিশ্বব্যাঙ্ক। এখন প্রশ্ন হল, বৈদেশিক সাহায্য একেবারে বন্ধ থাকার পরেও কোন ম্যাজিকে ফের স্থিতিশীল হচ্ছে সেই দেশের অর্থনীতি? আজ সেটা জানার চেষ্টা করব এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে।
আফগানিস্তানের অর্থনীতির দিকে যদি একটু চোখ রাখতে হয় তাহলে বিশেষ কয়েকটা বিষয় আমাদের আগে নজরে আসবেই। আফগানরা মূলত কৃষি এবং পশুপালনের মাধ্যমেই নিজেদের উপার্জনের পথটা পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করেছিলেন। একটা ব্যপার, আফগানিস্তানে কৃষিকাজের উপযোগী জমির কিন্তু বেশ অভাব রয়েছে। দেশটিতে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন উপত্যকায় কৃষিকাজ করা হয়। এই দেশের অন্যতম প্রধান ফসল হচ্ছে গম। এছাড়া যব, ভুট্টা এবং তুলোর চাষ হয়ে থাকে। তবে আফগানিস্তান মূলত বিখ্যাত ড্রাই ফ্রুটসের জন্য। এই দেশে বাদাম, আঙুর, তরমুজ, কিশমিশ, চেরি, এপ্রিকট বা ডুমুরের ফলন হয় সর্বাধিক। এছাড়া আফিমের চাষও এই দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছাপ রেখেছে। এছাড়া আফগানিস্তানের হস্তশিল্পের কাজ গোটা বিশ্বে ভালোরকম সমাদৃত হয়েছে। এখানেই একটা তথ্য দিয়ে রাখি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আফগানিস্তানে ভারি শিল্প একটু ডালপালা ছড়িয়ে বসেছিল। টেক্সটাইল, শুকনো খাবার এবং ফলের চাষ, রাসায়নিক সার, সিমেন্ট বা চর্মজাত পণ্যে আফগানিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ছাপ রাখছিল। আফগানিস্তান মূলত যেসকল পণ্য রফতানি করে থাকে তাদের মধ্যে অন্যতম হল শুকনো ফল, বাদাম, নানা ধরণের পাথর, পশম, তুলোর মত পণ্য। পরিবর্তে আমদানি করে খাবার, কাপর, পেট্রোলিয়াম জাত বিভিন্ন পণ্য এবং মোটরযান। ছোট্ট একটা হিসাব। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়। তারপর ভারত, পাকিস্তান, ব্রিটেন এবং জার্মানি সহ সোভিয়েতের বিভিন্ন প্রজাতন্ত্র দেশগুলো আফগানিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমেরিকা এসেই আফগানিস্তানের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বাণিজ্য আটকে দেবার কাজটি খুব মসৃণভাবে করতে পার্ল। ফলে ১৯৮৬ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের বাণিজ্য একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় আমদানি এবং রফতানি খাতের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতির অঙ্কটাও চওড়া হয়। আফগানিস্তান সেই সময় রফতানি বাবদ যেখানে আয় করত মাত্র ১২৫ মিলিয়ন ডলার, সেখানে আমদানি বাবদ খরচ হত প্রায় ৫২৪ মিলিয়ন ডলার মতন। এই বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেও মার্কিন প্রশাসনের হাতটি থাকার জন্য আফগান প্রশাসন মোটের ওপর চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল দেশটার অর্থনীতি। কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই বাইডেন সকল আমেরিকান সেনাদের আফগানিস্তানের ঘাঁটি ছেড়ে দিয়ে নিজের ঘরে ফেরত আসার কথা ঘোষণা করেন। তারপরেই তালিবানদের হাত এসে পড়ে আফগানিদের মাথায়। দেশটা যে এবার অন্ধকারে তলিয়ে যাবে, সেই বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন অনেকেই। কিন্তু যা হবে বলে ভেবেছিলেন অনেকেই, আজ সেই সমীকরণ একেবারে বদলে যেতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাঙ্কের একটি রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, আগের থেকে ক্রমশই স্থিতিশীলতার দিকে এগোচ্ছে আফগানিস্তানের অর্থনীতি। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে আফগানিস্তান ১৭০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করে। যেটা ২০২১ সালের থেকে ৯০% বেশি! এমনকি আমদানি খাতেও আফগানিস্তান ভালোরকম নজির তৈরি করেছে। আমদানির দিকে নজর দিলে দেখা যাচ্ছে, আফগানিস্তানকে পণ্য আমদানিতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে চিন, ইরান এবং পাকিস্তান। এখানেই শেষ নয়। আরও একটি তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, আফগানিস্তানে মুদ্রাস্ফীতির চাপ অনেকটাই কমেছে গত বছর জুলাই-এর পর থেকে। এমনকি নভেম্বরেও মুদ্রাস্ফীতি সেই দেশে হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৯.১ শতাংশ মতন। বিশ্বব্যাঙ্ক বলছে, আফগানিস্তানের রাজস্ব সংগ্রহ ক্রমশই সেই দেশের অর্থনীতির ভিত শক্ত রাখতে সাহায্য করছে। আমরা সকলেই জানি যে, রাজস্ব আদায় তখনই শক্তিশালী হবে, যখন সেই দেশের অর্থনীতি ভালো জায়গায় থাকবে। অন্তত অর্থনীতি সচল থাকলে তবেই রাজস্ব সংগ্রহে সরকার উপকৃত হয়। বিশ্বব্যাঙ্কের আরও একটি তথ্য থেকে জানা গিয়েছে, সেখানকার মানুষদের মজুরির অঙ্কটাও গত ডিসেম্বর থেকে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি সেই দেশের বেসামরিক খাতে যেসকল কর্মীরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন, তাঁরাও মাইনে পেয়েছেন নিয়মিতভাবে। আর সবথেকে অবাক করা বিষয় হল, আফগানিস্তানে মহিলা কর্মচারীদের বিষয়টা। আমরা সকলেই জানি কট্টরপন্থী তালিবান যুগে আফগান মহিলাদের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু সমীক্ষা একেবারে এই ধরাবাঁধা ভাবনাচিন্তা থেকে বার করে এনে সম্পূর্ণ নতুন একটি তথ্য প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, আফগান মহিলারা যারা এখনো কাজ করেন, তাঁদের বেতন নাকি পুরুষদের থেকে অনেকটাই ভালো হয়েছে। এবং তাঁরা নিয়মিতভাবে স্যালারিও পাচ্ছেন। শুধু অসুবিধে যেখানে, সেটা হল, আফগানিস্তানে এখনো নগদ অর্থের একটা ব্যপক ঘাটতি রয়েছে। সেই দেশের ব্যাঙ্কিং সিস্টেমও একেবারেই মজবুত নয়। ফলে মাইনে পেলেও ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে গিয়ে তাঁদের ভালোরকম হ্যাপা পোহাতে হচ্ছে।
প্রতিবেদন শেষ করার আগে আরেকটা কথা। ২০০৩ সালে আফগানিস্তানে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১০ লক্ষের কাছাকাছি। যুদ্ধের কারণে সেই দেশ শ্রমশক্তিতে অন্যান্য দেশের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। তারপর ক্রমশই চওড়া হতে থাকে বেকারত্ব, যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, এমনকি দক্ষ শ্রমিকের ভালোরকম ঘাটতি দেশটার অর্থনীতিকে বেশ সংকটে ফেলে দিয়েছিল। এরই মধ্যে নতুন করে তালিবান সরকার আসায়, দেশটা যে একেবারে গোল্লায় যেতে বসেছে, সেই আশঙ্কাও করেছিলেন বহু বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তালিবান সরকারের আমলে সেই ছবিটাই ক্রমশ বদলাতে চলেছে। একদিকে যখন প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান চরম আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেই দেশের প্রশাসনিক অপদার্থতার বিষয়টা গোটা বিশ্বের কাছে প্রতিদিন চওড়া হচ্ছে, সেখানে তালিবানের মত কট্টরপন্থী সরকারের হাতে দেশের অর্থনীতিতে জোয়ার আসাটা ম্যাজিকের থেকে কম কী? আপনাদের কি মতামত? কেন আফগানিস্তানের অর্থনীতি এভাবে সচল হচ্ছে? তাহলে কি তালিবানের যে ইমেজ দেখতে আমরা অভ্যস্ত, আসলে সেই ইমেজ থেকে বেরিয়ে নিজের দেশকে গ্লোবাল মার্কেটের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামাতে চাইছে তালিবান?
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ