Trending
আচ্ছা ভাবুন তো, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত যে মানুষটা সম্পর্কে তেমন একটা কেউ জানতেন না আজ তিনিই বলতে গেলে দেশের শেয়ার মার্কেটের মুখ হয়ে উঠেছেন। মানে এই যে কয়েক বছরে হইহই করে নিজের টাকা পয়সা ধন সম্পত্তি বাড়িয়ে একেবারে তিন নম্বরে উঠে গেলেন, আজ তাঁকে নিয়েই জোর চর্চা। আমি বলছি আদানির কথা- সেটা এতক্ষণে সবাই বুঝতে পেরেছেন। হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট আসা মাত্র শোরগোল পড়ে গেছে দেশের শেয়ার বাজারে। যেভাবে আদানির শেয়ার নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে, সেটা যেন সাপ-লুডোর খেলা! সাপের মুখে পড়লে যেমন হুশহুশ করে নেমে আসতে পারেন একেবারে ৯৯ থেকে শূন্যে, এখন সেই অবস্থাই তৈরি হবে নাতো? আদানি যদি সবদিক থেকে পড়তে শুরু করে তাহলে সেটা শুধু আদানির ক্ষতির মধ্যেই আটকে থাকবে না, বরং সেটা দেশের জন্য বড়সড় আর্থিক ক্ষতির ধাক্কা হতে পারে। কিভাবে সেটাই বলব আজকের প্রতিবেদনে।
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ ফার্ম হচ্ছে একটি মার্কিনী সংস্থা। যে বিভিন্ন দেশের শেয়ার বাজার ওঠা-পড়ার দিকে লক্ষ্য রাখে। আর কোন কোম্পানি এদিক থেকে ওদিক করলেই তাকে জাপ্টে ধরে কৈফিয়ত চায়। এবার সেটার জন্য প্রস্তুত হতে হয়েছে আদানিকে। আদানি গ্রুপের পক্ষ থেকে ৪১৩ পাতার একটা রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, হিন্ডেনবার্গের সব তথ্য আসলে ভুল। এটা নাকি পিএম মোদীর ইমেজ, দেশের ইমেজ সব ধুলিস্যাৎ করার জন্য প্ল্যানিং। হিন্ডেনবার্গের সাফ জবাব, এত ভয় কিসের বাপু? প্রয়োজন পড়লে আমেরিকায় এসে মামলা করো আর নিজেদের যা কাগজপত্র আছে, সেগুলো জমা দাও। আসলে অনেকেই বলছেন, আদানি গ্রুপ বাইরে থেকে খুব শক্তপোক্ত মনে হতেই পারে কিন্তু ভেতরের পুরোটাই ফাঁপা। ইচ্ছাকৃত স্টক ম্যানিপুলেশন, অ্যাকাউন্ট জালিয়াতি এসব করেই আদানি গ্রুপের রমরমা। অন্তত হিন্ডেনবার্গ সেটাই বলছে। একটা বিষয় ভেবে দেখুন, কোভিডের আগে পর্যন্ত আদানি গ্রুপের নাম সাধারণ মানুষের কাছে খুব একটা পরিচিত ছিল না। কিন্তু কোভিডের টাইম থেকে যখন অন্যান্য সংস্থার শেয়ার নিচের দিকে পড়তে শুরু করেছিল, ঠিক সেই সময় থেকে আদানি গ্রুপের শেয়ার বেড়েছে ঊর্ধ্বমুখী। ঊর্ধ্বমুখী মানে আদানির দৌড় তখন যেন উসেইন বোল্টের দৌড়কে টেক্কা দিয়ে দেবে। একের পর এক কোম্পানি, একের পর এক সেক্টরে ডালপালা ছড়িয়ে বসতে শুরু করেছিল আদানি গ্রুপ। নাও, এখন যদি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরোয় তাহলে সেটা বেশ ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এই কয়েকদিনেই আদানি গ্রুপ প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ হারিয়েছে। হবে নাই বা কেন বলুন? যে মানুষটা আজ ধারের পর ধার করে নিজের শেয়ার ভ্যালু বাড়িয়ে তিন নম্বরে উঠে এসেছিল, বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করে কোটি কোটি টাকা ঢেলেছিলেন, আজ সেই সর্ষের মধ্যেই ভূত দেখা যাচ্ছে? তাহলে দোষটা তো আর লগ্নিকারিদের দেওয়া যায় না। তাঁরা তো ভয় পাবেনই। ফলে আদানি গ্রুপে ইনভেস্ট করা থেকে সংযত থাকবেন তাঁরাও। এমনকি যারা ইনভেস্ট করে বসে আছেন, তাঁরাও চাইবেন সব বিক্রি করে এই ঝামেলা মুক্ত হতে। ফলে আদানি গ্রুপ যে গোঁত্তা খাবে সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। একটা বিষয় লক্ষ্য করার মত। এই যে আদানি গ্রুপ হঠাৎ করে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টের এগেন্সটে দাঁড়িয়ে ভারতের মূল্যবোধ ইত্যাদিকে হাতিয়ার করার চেষ্টা করছে তাহলে নীরব মোদী, বিজয় মাল্য বা সুব্রত রায়ের ক্ষেত্রে কই তেমন তো কোন অভিযোগ উঠল না। এরা তো প্রত্যেকেই জালিয়াতি করে পালিয়েছেন বিদেশে। আসলে বিজেপির উত্থান এবং আদানির উত্থান- এই দুটোকে যদি পাশাপাশি রাখা যায়, তাহলে দেখতে পাব আদানি এবং বিজেপি একসঙ্গে হামলোগ ভাইভাই-এর মত হাত ধরাধরি করেছিল। কারণ বিজেপি সরকার আসার পরেই আদানি গ্রুপের ব্যবসা ফুলেফেঁপে চারাটি থেকে বটবৃক্ষ হয়েছে। সুতরাং পিএম মোদীর ইমেজ খারাপ হওয়ার প্রসঙ্গ টানাটা নিন্দুকদের কাছে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। তাঁরা মনে করতেই পারেন যে, বিজেপির বদান্যতায় আদানির এমন লম্ফঝম্ফ। তার মানে কি দাঁড়ালো? আদানি গ্রুপ যদি ডোবে, তাহলে বিজেপির মুখেও পড়বে চুনকালি।
আর একটা বিষয়ও বেশ অদ্ভুত লাগল। একদিকে যখন অন্যান্য কোম্পানি, ইনভেস্টররা আদানির মাথা থেকে ছাতাখানি সরিয়ে নিচ্ছে ভয়ে তখন এলআইসির মত কোম্পানি কিভাবে বিনিয়োগ করে আরও? বুকের পাটা আছে বটে। এদের বিনিয়োগ দেখে যেন পরোক্ষে একটা ক্লিনচিট দেওয়া হচ্ছে, তোরা যে যা বলিস ভাই আমার আদানিকেই চাই। আর দেশের জনগণ- এক্কেবারে ভয় পাবেন না, এই দেখুন- আমরা বিনিয়োগ করছি, আপনারাও করুন গোছের একটা ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা। যে এলআইসি সাধারণ মানুষের পরিশ্রমের টাকার ওপর দাঁড়িয়ে তারা এমন নির্দ্বিধায় আদানিতে বিনিয়োগ করছে কেন? কোন সরল সমীকরণ কি রয়েছে? বেশ কয়েক মাস আগেই আদানির এই লাফিয়ে লাফিয়ে সম্পদ বৃদ্ধিকে অনেক নিন্দুক ভালোচোখে দেখেন নি। এসবিআই থেকে শুরু করে ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠানগুলোর আদানির প্রতি সরল বিশ্বাস রাখার মধ্যে কেমন একটা টকটক গন্ধ পেয়েছিলেন। কারণ আদানি গ্রুপের মাথায় ধারের অঙ্ক কয়েক লক্ষ কোটি। সুতরাং, আদানি গ্রুপ যদি ডোবে তাহলে জিডিপি নিয়েও সে ডুববে। আর এই ভরাডুবি তখন ইন্ডিয়ান ইকোনমির জন্য বেশ সংকট তৈরি করবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাহলে এখন উপায় কী? কোন উপায় নেই। সাধারণ মানুষ আর কী করবেন? যারা বিনিয়োগ করে বসে রয়েছেন তাঁরা এখন সংকট কাটানোর অপেক্ষায় দিন গুনছেন।
অনেকে মনে করছেন, আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে সেটা ইচ্ছাকৃত। কারণ ভারত যেরকম ফিনানশিয়াল দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে, সেটা আমেরিকা চিনের কাছে চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর যে কারণে সবদিক থেকে ভারতকে প্যাঁচে ফেলার একটা মোক্ষম ষড়যন্ত্র। প্রথমে মোদীর ওপর বিবিসির ডকুমেন্টারি, তারপর এখন আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে ওঠা এসব কঠিন অভিযোগের কেত্তন। অর্থাৎ ইনিয়ে বিনিয়ে এটাই বলার চেষ্টা যে, শুধু মোদী ম্যাজিক নয় তার সঙ্গে আদানির ম্যাজিকও ধরে ফেলতে চাইছে সকলে। আর সেটা ইচ্ছাকৃত করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, আমাদের ভারতবর্ষে তো আদানি ছাড়াও অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা শার্কের থেকেও বড়। তাঁদের মধ্যে তো এই নিয়ে তেমন ভয়ভীতি ধরা পড়ে নি। কই, তাঁরা কেন এগিয়ে আসছে না ফ্রন্টফুটে? যত দোষ নন্দ ঘোষ করে লাভ নেই। আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ উঠেছে, তার কোনটাই কিন্তু এখনো প্রমাণিত নয়। আর প্রমাণ ছাড়া কেই বা কথা বলে? সুতরাং হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট আসুক আর যাই হয়ে যাক, আদানির টাইটানিক এখনো এগিয়ে চলেছে। দেশের মানুষের বুক ঢিপঢিপ করছে, সমানতালে বুক ঢিপঢিপ করছে বিজেপি-রও।
বিজনেস প্রাইম নিউজ
জীবন হোক অর্থবহ