Agriculture news
মাটি ছাড়া কৃষিকাজ সম্ভব? প্রশ্নটা অমূলক মনে হতেই পারে। তবে এই প্রশ্নের গুরুত্ব কম নয়। গোটা বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বছর বছর। সেদিক থেকে এগিয়ে রয়েছে চিন এবং ভারত। পপুলেশন বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য কৃষিকাজের যোগ্য জমির অভাব দেখা দিচ্ছে। তার সঙ্গে মাটির দূষণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে আরও বড় চিন্তার কারণ। এমন একটি পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে খাদ্য সংকটের আশঙ্কাও দেখাচ্ছেন অনেক বৈজ্ঞানিক। তাই অদূর ভবিষ্যতে কিভাবে এই সমস্যার হাত থেকে রেহাই মিলতে পারে সেই নিয়ে আলোচনা সারছেন তাঁরা। বিভিন্ন রকম এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যাওয়া আজ বৈজ্ঞানিকরা বলছেন যে, মাটি ছাড়াও গাছ বাড়তে পারে। ফলন হতে পারে বেশ ভালোরকম। কিন্তু মাটি ছাড়া কৃষিকাজ? আজ্ঞে হ্যাঁ। বিজ্ঞানের দৌলতে আজ এই প্রযুক্তির নাম হাইড্রোপনিক্স। অর্থাৎ, ফারমিং উইদ আউট সয়েল। হাইড্রোপনিক্স কি এবং কিভাবে সেটা হতে পারে আজকের প্রতিবেদনে আলোচনা সারা যাক এই বিষয় নিয়ে।
ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের কথা মনে পড়ছে? অথবা মেক্সিকোর অ্যাজটেকের ভাসমান বাগান? খেয়াল করে দেখলে বুঝতে পারবেন এই সবই হাইড্রোপনিক্সের দুর্দান্ত উদাহরণ। ১৯৩০ সালের গোড়ার কথা। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির একজন বিজ্ঞানী প্রফেসর উইলিয়াম গেরিকে প্রথম মাটিবিহীন চাষের কথা বলেন। মাটির পরিবর্তে খনিজ পদার্থে ভর্তি তরলের মধ্যে সফলভাবে চাষবাসের পরীক্ষা করেন। বলাই বাহুল্য, তিনিই এই পদ্ধতির নাম দিয়েছিলেন হাইড্রোপনিক্স। হাইড্রোপনিক্স এসেছে দুটি গ্রীক শব্দ থেকে। হাইড্রো অর্থাৎ জল এবং পনিক্স অর্থাৎ কাজ। তার মানে হাইড্রোপনিক্স হল এমন একটি উপায়, যেখানে মাটি ছাড়া একটি গাছ ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে। আর উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে নিউট্রিয়েন্ট যা আসলে খনিজ পদার্থ দিয়ে তৈরি একটি তরল। সেই তরলের উপাদান কি কি? নুড়ি, পাথর, বালি, পিট মস, পারলাইট, নারকেলের ছোবড়া, কাঠের গুঁড়োর মত কিছু উপাদান। দেখুন আমরা সকলেই জানি, একটি গাছ বেড়ে ওঠে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আর সালোকসংশ্লেষ কিভাবে হয়? সূর্যের আলো এবং পাতায় থাকা ক্লোরোফিলের মাধ্যমে। মাটি থাকলে একটি গাছ ওপরের দিকে বেড়ে উঠতে পারে সহজে। তার কারণ, মাটি থেকেই উদ্ভিদ পুষ্টিগুণ সংগ্রহ করে এবং একটি গাছকে মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে বেড়ে ওঠা এবং সেই গাছকে ধরে থাকার জন্য মাটির ভূমিকা থাকে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু একটা বিষয় ভেবে দেখুন। যদি মাটি ছাড়া একটি উদ্ভিদকে বেড়ে ওঠার জন্য সবরকমের সামগ্রীগুলো প্রদান করা হয়, তাহলে কিন্তু গাছ তার বৃদ্ধির জন্য মাটির ওপর আর নির্ভরশীল থাকবে না। সেই প্রক্রিয়াই আজ ব্যবহার করা হচ্ছে হাইড্রোপনিক্স সিস্টেমের মাধ্যমে।
হাইড্রোপনিক্স সিস্টেম ব্যবহার করলে কৃষিজমিতে থাকা বিভিন্ন শক্ত পদার্থ, কীটনাশক, সারের মত একাধিক বিষয়গুলোকে এরিয়ে চলা যায়। যেটা একটা গাছের বৃদ্ধির জন্য কোনরকম প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে না বলেই জানা যাচ্ছে। হাইড্রোপনিক্স সিস্টেমে চাষ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। যদি সবদিক ঠিক রেখে হাইড্রোপনিক্স চাষ করা যায়, তাহলে এর মত সাশ্রয়ী আর কিছু হতে পারে না। কারণটা পরপর বলছি, যাতে বিষয়টা ক্লিয়ার হয়।
মাটির তুলনায় বৃদ্ধি তাড়াতাড়ি
হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতি ব্যবহার করলে মাটির তুলনায় গাছের বৃদ্ধি আরও ভালোভাবে হতে পারে। অন্তত স্বাভাবিকের থেকে বৃদ্ধি দাঁড়াতে পারে ২০ শতাংশ বেশি। তার কারণ, গাছের শেকড় পুষ্টিতে ভরপুর দ্রবণে ডুবিয়ে রাখার জন্য গাছের শেকড়কে মাটির বহু গভীরে পৌঁছতে হয় না। জল এবং পুষ্টি সহজেই শেকড় শোষণ করতে পারে। ফলনও মাটির থেকে অন্তত ২০-২৫% বেশি হয়।
কম জায়গায় চাষ
হাইড্রোপনিক্স সিস্টেম ব্যবহার করলে কম জায়গায় অনেকটা চাষ করা সম্ভব। কারণ, মাটিকে ব্যবহার করে যদি স্বাভাবিক নিয়মে চাষ করতে হয়, সেক্ষেত্রে বীজ বপনের জন্য নির্দিষ্ট একটি দূরত্ব মেনটেন করতে হয়। হাইড্রোপনিক্সের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। শিকড় ছোট হওয়ার কারণে এবং পুষ্টি যথাযথ গ্রহণ করতে পারার কারণে মাটির ঝামেলা নেই। ফলে কম জায়গায় বেশি পরিমাণ চাষ করা সম্ভব।
জলের সাশ্রয়
হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে চাষ করলে জলের সাশ্রয় হতে পারে ৯০% মতন। জলের বাষ্পীভবন বন্ধ করার জন্য যেহেতু জলের পাত্র বা পাইপ ব্যবহার করা হয়, তাই গাছগুলো নিজের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় জল সংগ্রহ করে নেয়। বাকি জল নষ্ট না-হয়ে জমা থেকে যায় পরবর্তী সময়ে ব্যবহারের জন্য। মাটিতে চাষ করলে যা অসম্ভব।
মাটির প্রয়োজন নেই
মাটির প্রয়োজন পড়ে না যদি হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে চাষ করার কথা ভাবা হয়। এর ফলে জন্ম নেয় না আগাছা। অন্যান্য কীটপতঙ্গের আক্রমণের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। প্রয়োজন পড়ে না কীটনাশকের। সুতরাং হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে ফলন হবে কোন বিষাক্ত প্রভাব ছাড়া।
সময় এবং পরিশ্রম
আমরা সকলেই জানি যে গতানুগতিক পদ্ধতিতে চাষ করলে সেক্ষেত্রে সময় এবং পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু হাইড্রোপনিক্স সিস্টেমটাই এমন যে এতে সময় এবং পরিশ্রম দুইই বেশ কম লাগে। অন্যদিকে ফলন আশা করা যায় অনেকটাই বেশি। ফলে হাইড্রোপনিক্স সিস্টেম সেদিক থেকে দেখতে গেলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কম সময়ে বেশি ফলন দিতে পারে হাইড্রোপনিক্স।
বারান্দা হোক বা ছাদ- ছোট জায়গায় ভালো ফলনের জন্য হাইড্রোপনিক্স সিস্টেমের কোন বিকল্প নেই। ফুল থেকে বিভিন্ন ধরণের শাকসব্জি চাষ করা যেতে পারে হাইড্রোপনিক্স সিস্টেমের মাধ্যমে। লেটুস, কলমি, ধনেপাতা, বাঁধাকপি যেমন চাষ করা সহজেই সম্ভব, তেমনই বেগুন, ক্যাপসিকাম, টম্যাটো, ব্রোকোলি, শসা, ফুলকপি বা স্কোয়াশের ফলন হতে পারে হাইড্রোপনিক্স সিস্টেম ব্যবহার করে। এছাড়া ফুল চাষের মধ্যে রয়েছে চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, গোলাপ, অর্কিডের মতন বেশ কিছু উদ্ভিদ।
২০১১ সালের একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা গিয়েছে, গোটা বিশ্বে এখন হাইড্রোপনিক্স চাষের জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়ছে। ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে হাইড্রোপনিক্স সিস্টেম ব্যবহার করে। আমেরিকা, কানাডা, মেক্সিকো, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, ইজরায়েলের মত দেশগুলি এখন হাইড্রোপনিক্স সিস্টেমের মাধ্যমে চাষাবাদ করার দিকে বেশি ঝুঁকছে। হাইড্রোপনিক্স সিস্টেম ব্যবহার করে কৃষি অর্থনীতি মজবুত করছে ইউরোপ। কারণ বাণিজ্যিক দিকে যদি নজর দেওয়া যায়, তাহলে বলতে হবে নেদারল্যান্ড হাইড্রোপনিক্স সিস্টেম ব্যবহার করছে সবচেয়ে বেশি। টম্যাটো, ক্যাপসিকাম এবং শসা চাষ করা হচ্ছে নেদারল্যান্ডের ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার মত হাইড্রোপনিক্স ফসল উৎপাদন করছে। স্ট্রবেরির ফলনো বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছাপ রাখছে অস্ট্রেলিয়ায়। হাইড্রোপনিক্স সিস্টেম যে কৃষি অর্থনীতির জন্য দুর্দান্ত পদক্ষেপ হতে পারে সেটা বুঝতে পেরেছে জাপান। আর ইজরায়েলের কথা কী বলব? মরু এলাকায় লেবু, কলা এবং বেরির মত বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করে গোটা বিশ্বে নজির তৈরি করেছে দেশটি।
ভারতীয় অর্থনীতির অন্যতম মেরুদণ্ড কৃষি। একদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অন্যদিকে মাটির দূষণ ভারতের কৃষি অর্থনীতির সচল চাকা আটকে দেবার আশঙ্কা অনেকেই করেছেন। তাই আশঙ্কা যাতে সত্যি না-হয়, তার জন্য ভারতে হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে চাষের জনপ্রিয়তা একটু হলেও বেড়েছে। মুম্বই, ব্যাঙ্গালোরের মত শহরে চাষ করা হচ্ছে এই পদ্ধতিতে। কিন্তু যদি হাইড্রোপনিক্স সিস্টেমের ব্যবহার আরও কয়েকগুণ বাড়ানো যায় গোটা ভারতে, তাহলে সময় এবং শ্রমের সাশ্রয় ঘটিয়ে কৃষি অর্থনীতিকে মজবুত করবে এই হাইড্রোপনিক্স সিস্টেম। কিন্তু একটাই কথা। এই হাইড্রোপনিক্স সিস্টেম ব্যবহারে কিছু বাধা বা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তবে সেটা বলব পরবর্তী কোন প্রতিবেদনে। আপনিও চাইলে কিন্তু আপনার বাড়ির কোন খোলা জায়গায় হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষবাস করতে পারবেন। এমনই আরও ইন্টারেস্টিং টপিকের বিষয়ে জানতে হলে চোখ রাখুন বিজনেস প্রাইম নিউজে।
জীবন হোক অর্থবহ