Trending
ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং আফগানিস্তান। এই আটটি দেশের একত্রিত জোট সার্ক বা সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন। যা ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক শক্তিবৃদ্ধির কাজ করবে বলেই গঠন করা হয়। কিন্তু দেখা গেল, সার্ক নিজের ভাবনা রূপায়নে একেবারে ব্যর্থ হয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে কোনভাবেই সেই জোট তৈরি হয়নি। বরং হাজারো জটের কারণে আজ দিনে দিনে নিজের ক্ষমতা হারাতে বসেছে সার্ক। কিন্তু কী সেইসকল জট? কেনই বা সার্ক দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটের জন্য অকেজো হয়ে পড়ছে? বন্ধুরা, আজকের প্রতিবেদন পড়ুয়াদের জন্য হতে চলেছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে আলোচনা করব সার্ক কী, কোন উদ্দ্যেশ্যে সার্ক গঠন করা হয়েছিল এবং কেন সার্কের ভবিষ্যৎ ক্রমশই অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে।
সার্ক প্রতিষ্ঠার আসল কারিগর বাংলাদেশ। পূর্ববঙ্গের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউর রেহমান প্রথম সার্ক প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন। তার পেছনে অনেকগুলো উদ্দ্যেশ্য ছিল। ১৯৮৫ সালে যখন কোল্ড ওয়ার পুরোদমে চলছে, তখন ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং পাকিস্তান প্রথম সার্কের সদস্য হিসেবে একজোট হয়। এরপর ২০০৭ সালে সার্কের সঙ্গে যুক্ত হয় আফগানিস্তান। কিন্তু প্রথম থেকেই সার্কের উদ্দ্যেশ্য ছিল পরিষ্কার। দক্ষিণ এশিয়ার সার্ক সদস্যভুক্ত দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য স্থাপন করা এবং এক দেশের প্রতি অপর দেশের বিশ্বাসের জায়গা মজবুত রাখা। ২০০৭ এর পর সার্কের অবজারভার স্টেট হিসেবে উঠে আসে অস্ট্রেলিয়া, চিন, জাপান, ইরান, মরিশাস, ইউএস, ডেনমার্ক, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপিয় ইউনিয়ন। এখন প্রশ্ন করতে পারেন যে সার্কের উদ্দ্যেশ্য কী ছিল?
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সার্ক নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, সার্ক আসলে দক্ষিণ এশিয় এলাকায়, নিজের সদস্যভুক্ত দেশগুলির মধ্যে আত্মনির্ভরতা খুব ভালোভাবে বাড়িয়ে তুলবে। একইসঙ্গে দারিদ্র্য দূরীকরণ, সাক্ষরতার মত বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সলিউশন খোঁজার চেষ্টা করবে। যা সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয় রাষ্ট্রগুলিকে একজোট করে বিশ্ব মানচিত্রে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুর্দান্ত একটা প্রভাব ফেলবে।
উন্নয়নঃ সার্ক সদস্যবুক্ত রাষ্ট্রগুলি আর্থিকভাবে নিজেদের সমৃদ্ধ করবে। একইসঙ্গে সমাজের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এগিয়ে যাওয়াই হল সার্কের উদ্দ্যেশ্য।
আত্মনির্ভরতাঃ সার্কের সদস্য দেশগুলিকে নিজ নিজ স্বাধীনতার দিকটা ভালো করে খেয়াল রাখতে হবে। যাতে কোনভাবেই নিজেদের স্বাধীনতা না খর্ব হয়। একইসঙ্গে সার্কের সদস্য দেশগুলি একে অপরের সঙ্গে যৌথভাবে নিজেদের আত্মনির্ভর হবার শক্তি বাড়াতে পারে।
সহযোগিতাঃ শুধু আর্থ-সামাজিক নয়, কারিগরি, বিজ্ঞানের মত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সার্কের সদস্য দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক মত বিনিময়, একে অপরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করতে পারে। একইসঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। যাতে আন্তর্জাতিক স্তরে সহযোগিতা পেতে কোন সমস্যায় না পড়তে হয়।
নিরাপত্তা এবং শান্তিঃ সার্কের সদস্য দেশগুলি যাতে দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলে নিজেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং সন্ত্রাস দমন করতে পারে, আর একইসঙ্গে একে অপরের মধ্যে শান্তি বজায় রাখতে পারে, সেটা ছিল সার্ক গঠনের অন্যতম শর্ত।
এছাড়া দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলে যাতে সংবেদনশীলতার পরিবেশ অক্ষুন্ন থাকে, একইসঙ্গে বজায় থাকে ভৌগলিক অখণ্ডতার মত বিষয়, সেই সব দিকগুলোয় কড়া নজরদারি রাখার কথা ছিল সার্কের।
আমরা সকলেই জানি, নিজেদের মধ্যে যদি আর্থিক সহযোগিতার বিষয়টা শক্তিশালী হয় তবেই একটা সদস্য দেশগুলির মধ্যে নির্ভরতা সহ এই সকল বিষয়গুলো বেশি মাত্রায় নজরে আসে বা লক্ষ্যপূরণ সম্ভব হয়। আর যে কারণে সার্ক ১৯৯৩ সালে তৈরি হয় সার্ক প্রেফারেনশিয়াল ট্রেডিং এগ্রিমেন্ট (SAARC Preferential Trading Agreement or SAPTA) বা সাপটা। এর মাধ্যমে ট্রেড কনশেসন, ট্যারিফ রিডাকশন এবং দক্ষিণ এশিয়ার একেবারে পিছিয়ে পড়া দেশগুলিকে স্পেশ্যাল নজরে রাখার বিষয়টা ভাবা হয়। এরপর ২০০৪ সালে তৈরি করা হয় South Asian Free Trade Area (SAFTA)-কে লঞ্চ করা হয়। সাফটার উদ্দ্যেশ্য ছিল সার্কের সদস্য দেশগুলির মধ্যে ট্রেডের সময় কাস্টম ডিউটি কমিয়ে আনা। ৩৮ বছর হল। সার্ক এতগুলো বছরে যে কিছুই করতে পারেনি, সেটা বলা ভুল। এই কয়েক বছরে সার্ক একটা ভালোরকম নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পেরেছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, সার্ক ৪৪ বিলিয়ন ডলারের এক মজবুত বিজনেস হাব তৈরি হতে পারে। কিন্তু এতো সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সার্ক প্রতিদিন স্রেফ ব্যর্থতাই লক্ষ্য করেছে। কেন, এবার সেই নিয়েই বলব।
সার্কের ব্যর্থতার জন্য ভারত-পাকিস্তানের দীর্ঘ অশান্তিকেই দায়ী করছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। আর এটার জন্য কি ব্রিটিশ রাজত্বের তৈরি করা অশান্তি সৃষ্টির কলোনিয়াল লিগ্যাসিকেও কি দায়ী করা উচিৎ নয়? আপনারা ভেবে দেখুন, সার্কের সদস্য দেশগুলির মধ্যে জায়েন্ট দেশ ভারত এবং বাংলাদেশ ছাড়া পাকিস্তানের অবস্থা ঠিক কোথায়? সেই শুরুর কাল থেকেই পাকিস্তানে যে পলিটিক্যাল টার্মঅয়েল চলছে, সেটা কি একেবারেই দায়ী নয়? কিন্তু সবথেকে অদ্ভুত বিষয় হল যে, সার্কের অন্যান্য দেশগুলো ভারতকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি। তার অন্যতম কারণ ভারতের সুবিশাল ভৌগলিক বিস্তার এবং ভারতের ক্ষমতা। এখানেই বলে রাখি, জিয়াউর রেহমান নিজেও খানিকটা এই ভয় থেকেই সার্ক প্রতিষ্ঠার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। এছাড়া বহিরাগত ইনফ্লুয়েন্স অনেকটাই কাজ করেছে, যেমন চিন। চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক একেবারেই বিশ্বাসের জায়গায় নেই। দুই দেশের বাণিজ্যে সেই প্রভাব না-পড়লেও, মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এর জায়গা ঠিক না-হবার কারণে ভারত এবং চিনের মধ্যে অশান্তি রয়েই গিয়েছে। একইসঙ্গে আফগানিস্তানে ভারত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেও সেখানে শুরু থেকেই বাধা দিয়ে এসেছে পাকিস্তান। আর এই সকল কারণের জন্যই সাফটা নিজেদের মধ্যে সেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির কাজটা এগোতেই পারেনি। বারবার ধাক্কা খেয়েছে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে ব্যবসা বৃদ্ধির রাস্তাটা। সেটা যেমন জটিল তেমনই সময়সাপেক্ষ- অন্তত এমনটাই মনে করছে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক। ট্রেড ডিল হওয়া সত্ত্বেও, গ্লোবাল বিজনেস ভলিউমের দিকে লক্ষ্য রাখলেও দেখা যাচ্ছে, সার্ক বিশ্ব বাণিজ্যের মাত্র ৭% করতে সক্ষম হয়েছে।
এছাড়া অন্যতম বড় একটা কারণ হোল, যদি আমরা ইউরোপিয়ান টেরিটরির দিকে নজর ঘোরাই, দেখতে পাব, সার্ক সদস্যভুক্ত দেশগুলিতে শিল্পায়ন অনেকটাই কম হয়। আর যে কারণে দক্ষিণ এশিয়র সার্কের ট্রেড এগ্রিমেন্টকে খুব দুর্বল বলে মনে করা হয়। তাই কোমা থেকে উঠতে হলে সার্ককে রফতানির পরিমাণ অনেকটা বাড়াতে হবে। নিজেদের মধ্যে বিশেষ কৌশল বা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। দ্বিপাক্ষিক এবং ত্রিপাক্ষিক ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টকে আরও মজবুত করতে হবে। আর বর্ডার সিকিওরিটি-তে প্রত্যেকটি দেশের কো-অপারেশন ভীষণভাবে প্রয়োজন। আর প্রয়োজন পলিটিক্যাল স্টেবিলিটি।
বন্ধুরা, সার্ক বিশ্ব মানচিত্রে অনেক কিছু করে দেখাতে পারত। সেই সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই, সেটা বলা যাবে না। কিন্তু এখন শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের যা হাল, তাতে সার্কের প্রদীপ যে যথেষ্ট নিভু নিভু- সেটা সকলেই জানেন। আজ ভারত বিশ্ব মানচিত্রে প্রত্যেকটা পদক্ষেপে একের পর এক রেকর্ড তৈরি করছে। কিন্তু ভারত ছাড়া সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলি সেভাবে কোন ছাপ রাখতে পারছে না গ্লোবালি। কিন্তু অন্যদিকে, সার্কের প্রতিবেশী রিজিয়ন তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সম্মিলিত জোট যাকে বলা হয় Association for South East Asian Nations বা ASEAN- তাদের সম্মিলিত জোট কিন্তু যথেষ্ট শক্তিশালী এবং তারা আজ নিজেদের মধ্যে দুর্দান্ত একটা ছাপ রাখতে পেরেছে। প্রিয় ছাত্রছাত্রী, আজ আমরা সার্ক নিয়ে প্রাথমিক একটা ধারণা আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। যদি এই ধরণের প্রতিবেদন আপনাদের ভালো লাগে তাহলে পরবর্তীতে আপনাদের বলব ASEAN –তৈরির যাবতীয় কারণ। ব্যাখ্যা করব ইতিহাস থেকে বর্তমান সময়ে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ASEAN।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ