Trending
প্রথম ছবিটা দুই কিংবদন্তি পরিচালক- সত্যজিৎ রায় এবং আকিরা কুরোসাওয়ার। আর দ্বিতীয়টা…
প্রথম ছবিটা ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের। আর দ্বিতীয় ছবিটা কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের।
কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল যখন প্রথম শুরু হয় নন্দনে, তখন সিনেমার নান্দনিক বিষয় প্রাধান্য পেত বেশি। বলতে বাধ্য হচ্ছি কারণ একটা সময় ছিল যখন এই ফেস্টিভ্যালের ডেলিগেটসদের মধ্যে উপস্থিত থাকতেন জানুসি, পানাহি বা মাজিদ মাজিদির মত পরিচালক। যারা সিনেমা তৈরি করে শুধু বিশ্ব বিখ্যাত হন নি, বরং সিনেমায় নতুন ভাষা, নতুন একটা রাস্তা খুঁজে দিয়েছেন। যাদের হাত ধরে সিনেমার আর্ট ফর্ম পরিপূর্ণতা পেয়েছিল। আর আজকের কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল! কোন দিক থেকেই মনে হচ্ছে না যে আজকের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ইন্টারন্যাশনাল। বরং অনেক বেশি ন্যাশনাল মনে হচ্ছে। কারণ একটাই। বলিউডি দাপাদাপি। সলমন খান, অনিল কাপুর, সোনাক্ষি সিনহা- যাদের জৌলুশ উপস্থিতি কার্যত ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আসল ভাবনাকেই দূরে ঠেলে দিল। এবং চলচ্চিত্র আর উৎসব দুটো আলাদা হয়ে ধরা দিল।
ছোটবেলায় আমরা পড়েছিলাম, একাধিক মৌলিক পদার্থ যুক্ত হয়ে একটি যৌগিক পদার্থ তৈরি হয়। সিনেমা সেই আর্ট ফর্ম- যেখানে একাধিক মৌলিক পদার্থ মিলে একটি নতুন মৌলিক পদার্থ তৈরি হয়। এবং শুধু তৈরি হওয়াই নয়। তার সঙ্গে থাকে ফিলোজফিকাল, বৌদ্ধিক বিকাশের একটা জায়গা। যারা সিনেমার ক্ষেত্রে বিচরণ করেন, তাঁরা প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে কি কমার্শিয়াল সিনেমা কোনদিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ঘোরাফেরা করে নি? নিশ্চয়ই করেছে। তার মধ্যে সবার প্রথমে বলা যেতে পারে তারান্তিনোর কথা। যার সিনেমায় ভায়োলেন্স থাকে পরতে পরতে। জ্যাংগো আনচেইনড, কিল বিল, পাল্প ফিকশন- কোন নামটা বাদ দিই? কিন্তু এখানেও ভায়োলেন্সকে পরিচালক নিয়ে গেছেন একটা শিল্পের পর্যায়। যে কারণে ফেস্টিভ্যাল ঘুরে আজ এই সকল সিনেমা কাল্ট ক্লাসিকের জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু তাই বলে সেটাকে ভাইজানের অ্যাকশন সিনেমার সঙ্গে তুলনা টানা উচিৎ নয়। বলতে একবারও বুক কাঁপে না যে, সলমন খান নিঃসন্দেহে প্রযোজকের টাকা দ্বিগুণ, তিন গুণ, চার গুণ করে ফেরত পাঠিয়েছেন, কিন্তু সলমনের সিনেমার নন্দনতত্ত্ব বিচার করতে বসলে মুশকিল। আরও মুশকিল হয়ে যাচ্ছে যখন দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মোটের ওপর জাতীয় স্তরের ফিল্ম পারসোনালিটিদের উপস্থিতি বেশি হয়ে যাচ্ছে। সলমনি কায়দায় ঠাটবাট দেখাতে দেখাতে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে স্পিচ, মুখ্যমন্ত্রী, সোনাক্ষি সিনহা, অনিল কপুরের নাচ- কোনদিক থেকে মনেই হচ্ছে না এটা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। বরং অনেক বেশি বর্তমান রাজ্য সরকারের একটি বলিউড-টলিউড ফিল্মি আড্ডা বলেই মনে হচ্ছে।
দর্শকদের সিটি, উচ্ছ্বাস, না-অভিনয় করতে পারা অভিনেত্রীদের থালা হাতে এদিকে ওদিকে ঘোরাঘুরি, একটু আধটু সলমনের মত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা বলার প্রচেষ্টা- সব মিলিয়ে কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল যেন আঞ্চলিক সিনেমার সঙ্গে মুম্বই ইন্ডাস্ট্রিকে মিলিয়ে দেবার একটা প্রচেষ্টা করা হল। চলচ্চিত্র উৎসব কেন করা হয় জানেন? আসলে প্রত্যেক আর্ট ফর্মের দুটো ধরন থাকে- একঃ যেটা সর্বজনগ্রাহ্য এবং দুইঃ যার মধ্যে থাকে সেই আর্ট ফর্মের এমনই এক নান্দনিক দিক, এমনই সব ফিলোজফিকাল মোমেন্ট যা মানুষকে ভাবাতে সাহায্য করে। সিনেমার ক্ষেত্রে আমরা যাকে প্যারালাল মুভি বলে থাকি। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারেঃ নায়ক আর মৌচাক। এই দুটো সিনেমার যদি বৌদ্ধিক দিকটা নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে বসা হয় তাহলে দেখা যাবে নায়কের ফিলোজফি অনেক বেশি এক সিনেপ্রেমীকে ভাবাতে সাহায্য করবে। কিন্তু মৌচাকের সর্বজনগ্রাহ্যতা অনেক বেশি। কিন্তু মৌচাক কি আর কখনো ফেস্টিভ্যালে ঘোরাঘুরি করার সিনেমা? আর নায়কের ঝুলিতে দেখুন- স্পেশ্যাল জুরি অ্যাওয়ার্ড বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ক্রিটিক্স প্রাইজ বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ন্যাশনাল ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, বেস্ট নন ইউরোপিয়ান ফিল্ম বোদিল অ্যাওয়ার্ড, সঙ্গে রয়েছে গোল্ডেন বিয়ার নমিনেশন। বাংলায় এমন পরিচালকের অভাব নেই যাদের সিনেমা বিশ্ব দরবারে ঘোরাঘুরি করে। ঋত্বিক-মৃণাল-সত্যজিত- এই গোল্ডেন ট্রায়োকে বাদ দিয়েও যদি দেখা যায় তাহলে রয়েছেন তপন সিনহা, অসিত সেনের মত পরিচালক।
মানতে হবে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই একটা গোল্ডেন এরা থাকে। সেই সময় ছিল। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তো বাংলার কাছ থেকে এই ধরণের সিনেমা আর পাওয়া যাচ্ছে না। আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত হালে বাংলার সিনেমাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন। তাঁর ফিল্ম লিস্টে রয়েছেঃ আসা-যাওয়ার মাঝে, জোনাকি এবং ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা। মানতেই হবে, ঠিক এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আদিত্য বিক্রম নতুন করে একটা প্রয়াস করছেন বাংলা সিনেমাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দেবার। কয়েকদিন আগে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা দোস্তজী সেই প্রয়াসকে কিছুটা গতি দেয়। যে প্রয়াস একটা সময় করেছিলেন পরিচালক গৌতম ঘোষ, যে প্রয়াস অভিনেতা অঞ্জন দত্তকে দিয়ে করিয়েছিলেন মৃণাল সেন, অপর্ণা সেনের মত পরিচালক। কিন্তু আজ!
সিনেমা বা যে কোন আর্ট ফর্মের দুটো দিক, যেমনটা আগে বললাম। একঃ কমার্শিয়াল এবং দুই প্যারালাল। কমার্শিয়াল মুভি তৈরি করা হয় প্রযোজক যে টাকা দেবেন সেই টাকা কয়েক গুণ বাড়িয়ে ফেরত দেবার জন্য। সেই বিচারে লাভ-ক্ষতির হিসেব কষা হয়। আর কিছু আর্ট ফর্ম নিখাদ তৈরি হয় মানুষের ফিলোজফিকাল চেতনাকে আরও মজবুত করে তোলা। ডিপ থিঙ্কিং-এর একটা জায়গা তৈরি করে দেওয়া। অনেকেই বলে থাকেন, প্যারালাল মুভি তৈরি করতেও তো টাকা লাগে। তাহলে সেক্ষেত্রে কি লাভ-ক্ষতির বিচার করা হয় না? তাহলে উত্তর না। হয় না। ঐ যে বললাম, প্যারালাল মুভির কাজ হচ্ছে গোটা সমাজকে নতুন এক দিশা দেখানো। না-হলে বুনুয়েল, তারকোভস্কি, আইজেনস্টাইন, চ্যাপলিন, হিচকক, গোদার, ত্রুফো, কিইয়েসলস্কির মত পরিচালকেরা নতুন করে ভাবতে বসতেন না। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে চলে বৌদ্ধিক, নান্দনিক তত্ত্বের একটা সুযোগ্য লড়াই। এই সকল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মাধ্যমে এমন কিছু সিনেমা এমন কিছু পরিচালক বিশ্ব দরবারে নিজের সৃষ্টিকে নিয়ে আসেন যা আদতে দিনের শেষে একটা আর্ট ফর্মকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। সেই উপস্থিতি, সেই ঝলক এখনো অনেকটাই লক্ষ্য করা যায় যদি জাতীয় স্তরের বা বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত কিছু আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেটিভ্যালের কথা ধরা যায়। ইফি, কান, বার্লিন, ভেনিস এমন আরও যা যা রয়েছে। কিন্তু আজকের কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল দেখে কার্যত অবাক হতে হয়। যেখানে একগুচ্ছের বলিউডি তারকার উপস্থিতি কার্যত ফেস্টিভ্যাল হিট করিয়ে দিলেও অন্তত সিনেপ্রেমী মানুষদের সামনে একটা প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরে। কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলা? যে বাংলা একটা সময় সৃষ্টি, কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির পুণ্যপীঠ ছিল, যে বাংলায় কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অন্তত বাম আমলে একটা অন্য দিশায় পৌঁছেছিল, আজ সেই ফেস্টিভ্যালের পরিণতি দেখলে খানিক হাসি পেতে বাধ্য। যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, বাংলার দর্শক ধীরে ধীরে লারজার দ্যান লাইফের দিকে বেশি ঘেঁসে বসে রয়েছে। উড়ন্ত হেলিকপ্টার থেকে ঝাঁপ, দশ-বারোটা গাড়িকে মেশিনগান দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া এগুলো কমার্শিয়াল সিনেমার জন্য একেবারে উপযুক্ত। কিন্তু দিনের শেষে তো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। সেখানে বলিউডি তারকাদের নাচানাচি যেন ফেস্টিভ্যালের গুরুত্বকেই ম্লান করে দেয়। তাই কিনা? ভাবুন…ভাবুন…ভাবা প্র্যাকটিস করুন। এখনো সময় রয়েছে। বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য যদি এভাবে বলিউডকে এগিয়ে আসতে হয় তাহলে কি দিনের শেষে আর প্যারালাল সিনেমার ফর্ম বেঁচে থাকতে পারে? আশাবাদী সিনেপ্রেমিরা বলবেন, পারে। আর আপনারা? মতামত জানান কমেন্ট বক্সে। সঙ্গে লাইক, শেয়ার আর নতুন হলে ভুলবেন না সাবস্ক্রাইব করতে আমাদের চ্যানেল বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ